স্বামীর আাদরযত্নে পালিত, সুখী সুখী চেহারার আদতে পুতুল বউদের দেখে কেন যেন দাসপ্রথার চেহারা ভেসে ওঠে। পুরুষতন্ত্র কত কৌশলেই না নারীর পায়ে শিকল পরায়। কখনও সেই শিকলের নাম ‘গহনা’, কখনও ‘প্রেম’, কখনও ‘মানসম্মান’, কখনও ‘সন্তান’, কখনও ‘সংসার’। নারী সেসব শিকল পরে দিব্যি আনন্দে ঘোরে-ফেরে আর ভাবে বাহ্! আমি কত সুখে আছি। কোনো মানুষ যদি অন্য কোনো মানুষকে সত্যিকারভাবে ভালোবাসে তাহলে সে ভালোবাসার মানুষটির উন্নতি চাইবে, চাইবে তার প্রতিভার বিকাশ হোক, সর্বোপরি চাইবে তার স্বাধীনতা। কারণ, বন্ধুত্ব হতে হয় সমানে-সমানে আর প্রেমও তাই। অথচ বিয়ে, সংসার, সন্তানের নামে এদেশে ঠিকঠাক নারীর পায়ে এক অদৃশ্য শেকল পড়িয়ে দেওয়া হয়।
স্বাধীনতার দায়িত্ব, স্বাধীনতার ব্যথা এবং স্বাধীনতার আনন্দ– কোনোটাই তারা অনুভব করতে পারে না আর তাই স্বাধীনতার চেহারা না দেখেই তারা ভেবে নেয় যে তারা খুব সুখে আছে। প্রাচীন যুগে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হত ক্রীতদাসকে। দাসের সর্বদাই চেষ্টা থাকত কীভাবে শিকল ভাঙা যায়। কারণ, শিকলটা প্রতি পদক্ষেপে তাকে মনে পড়িয়ে দেয় যে সে ক্রীতদাস। তার স্বাধীনভাবে বাঁচা বা চলার অধিকার নেই। কিন্ত সেই শিকল এমনই আআষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যা থেকে চাইলেও বের হওয়া যায় না। নারীদেরও ঠিক সেই অবস্থা।
প্রেম আর সংসারের জন্য প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করে নারীরা। লেখাপড়া জলাঞ্জলি দেয়, ক্যারিয়ার ত্যাগ করে। এই ত্যাগ স্বীকার শুধুমাত্র নারীদেরই করতে হবে যদিও প্রেম কিংবা সংসার শুধু একজন নারী একা করে না। সেখানে একজন পুরুষেরও সমান ভূমিকা থাকার কথা। অথচ যেকোনো সম্পর্কে পুরুষটি হয়ে ওঠে নিয়ন্ত্রণকারী আর প্রেম ও সংসারের জন্য ত্যাগ স্বীকার করা নারীর ভূমিকা দাঁড়ায় সে প্রেমিক কিংবা প্রেমিক-স্বামীর হাতের পুতুল ছাড়া আর কিছুই নয়।
নারীদের জন্য বানানো আরেকটি শিকলের নাম ‘মানসম্মান’। “তুমি একা চাকরি করতে যাবে অন্য শহরে?”, “তুমি সভা-সমিতিতে বক্তব্য রাখবে?”,”তুমি মঞ্চে নাচবে বিয়ের পরও?”, “তুমি রাত করে বাড়ি ফিরবে?”, “বিয়ের পরও তোমার ছেলেবন্ধু কিংবা অফিসের পুরুষ কলিগরা বাড়িতে আসবে?”,”হায়! হায়! পরিবারের মানসম্মান সব যে চলে যাবে!”
মানসম্মান নামক শিকলটির যে কী বিচিত্র রূপ! কোথায় কখন কোন নারীর জন্য যে মানসম্মান চলে যায় তা বোঝাই মুশকিল! ব্রিটেনের সংবিধানের মতো– এই অলিখিত মানসম্মানের কোনো শুরু নেই, শেষ নেই। আর এই মানসম্মান রক্ষার দায় একমাত্র নারীর ঘাড়ে।
নারীকে পড়ানোর জন্য আরেক ধরনের শিকলের নাম গহনা। বিয়েতে বউকে ৩০/৪০ ভরি সোনার গয়না দেওয়া হবে এই কথা শুনেই মধ্যবিত্ত মেয়ের পরিবার আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। আর তারপর প্রথম সন্তানের জন্মের পর, ‘বংশের বাতি’র মুখ দেখে শাশুড়ি যখন হীরার নেকলেস দেয় পুত্রবধূকে তখন এইসবে খুব অভ্যস্ত হয়ে ওঠে এক সময়ের মেধাবী, সম্ভাবনাময়ী ছাত্রীটি। চাকরি তো দূরে থাক পড়াশুনা বাকি থেকে গেলেও তার জজলাঞ্জলি দিয়ে দেয় শুধু “ছোট বাচ্চা ফেলে বাইরে নাই-বা গেলে ” কথাটি শুনে।
চাকরির কী দরকার, বিশেষ করে খাওয়া-পরার যখন অভাব নেই। এমন ‘গহনাদাতা’ শ্বশুরবাড়ির অনুরোধ কি পায়ে ঠেলা চলে? তারা তখন সেজেগুজে স্বামীর সঙ্গে দেশবিদেশ ঘোরে। সোনার শিকল পায়ে গয়না গায়ে অবিকল পোষা ময়নার মতো বুলি ছাড়ে!
নারীকে মুঠোয় পুরে রাখার সবচেয়ে মজবুত শিকলের নাম সন্তান ও সংসার। সন্তান জন্ম দেওয়ার পর থেকেই নারীকে পাখিপড়া করে শেখানো হয়– ‘মা হওয়া মানেই নিজের সব আনন্দ, সব চাওয়া-পাওয়ার হিসাব ভুলে সন্তানের জন্য জীবনধারণ করা’। যেন মা রক্তমাংসের মানবী নয়, তার কোনো চাহিদা থাকতে পারবে না, পারবে না জীবনটা নিজের মতো করে যাপনের অধিকার।
‘বাবা’ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তো একজন পুরুষকে চাকরি ছাড়তে হয় না, নিজের সব সুখ-সুবিধা-ইচ্ছা-অনিচ্ছা ছাড়তে হয় না। একজন বাবা তো নিজের ক্যারিয়ার, নিজের সৃজনশীল কাজ সবই বজায় রাখতে পারে। সকল নিয়মের বালাই কেবল একজন নারীর বেলায় বর্তায়।
স্বাধীনতার জন্য অনেক, অনেক কিছুর মোহ ছাড়তে হয়। এসব শিকল ছিঁড়ে, ভেঙেই এগোতে হয় নারীকে। তার চলার পথটা তখন আর মসৃণ থাকে না বটে, তবু তো সে পথ তার জীবনটা কারাগারের বাইরে নিয়ে যায়।