.

.

শৈশব থেকেই শিশুদের মধ্যে মাতা-পিতার প্রতি দায়িত্ব এবং কর্তব্যবোধ গড়ে তোলা হয় এবং শিক্ষাক্রমে এ বিষয়ের উপর রচনা ও প্যারাগ্রাফ অন্তর্ভুক্ত করা হয় যাতে তারা এ বিষয়ে সচেতন হয়। কিন্তু বাচ্চাদের প্রতি মাতা-পিতার দায়িত্ব সম্পর্কে যে সমান গুরুত্বের শিক্ষা দরকার, সে বিষয়ে খুব কম গুরুত্ব প্রদান করা হয়।

.

বৃদ্ধাশ্রমে বাসকারী প্রবীণদের দুর্দশা নিয়ে যেভাবে মিডিয়ায় সমবেদনা প্রকাশ পায়, তেমনি একটি শিশুর মানসিক ভাবনাকেও জনগণের সামনে তুলে ধরা উচিত।

.

মাতা-পিতার প্রতি যেমন সন্তানের দায়িত্ব আছে, তেমনি সন্তানের প্রতি মাতা-পিতার দায়িত্বও অপরিমেয়। একজন শিশুকে নিরাপদ, সুস্থ ও সুখী ভবিষ্যত দেওয়া তার মা-বাবার দায়িত্ব।

.

বাবা-মায়ের যে কোন নেগেটিভ আচরণ যা শিশুর উপর মানসিক বা শারীরিক আঘাত হানে, তাকে আইনের দৃষ্টিতে গুরুত্বের সাথে দেখা উচিৎ এবং শাস্তিসাপেক্ষ করা উচিৎ। আমার মতে, সন্তানের প্রতি যেমন মাতা-পিতার দায়িত্ব থাকে, তেমনি মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের দায়িত্বের তুলনায় মাতা-পিতার দায়িত্ব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেউ জন্ম নিয়ে এসে ধন্য হয় না, তার আগমন স্বেচ্ছায় নয়। একবার শিশু এই পৃথিবীতে আসার পর, যদি তার পথচলা সহজ এবং মসৃণ করা না হয়, এবং যদি সে কোনভাবে শারীরিক, মানসিক বা সামাজিক ক্ষতি ভোগ করে, তবে এর জন্য দায়ী ব্যক্তিকে আইনের আওতায় অপরাধী হিসেবে গণ্য করা উচিত এবং তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া উচিত।

.

শিশু কেবল মাত্র মা-বাবার সম্পত্তি নয়, তার নিজের মর্যাদা এবং অধিকার আছে। শিশুকে যে কোন প্রকারের অন্যায় আচরণ থেকে রক্ষা করা প্রতিটি সমাজের দায়িত্ব। শিশুর প্রতি যত্ন এবং সুরক্ষা প্রদান না করা, শৈশবকে দুঃসহ করে তোলা শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনই নয়, এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধও বটে। প্রতিটি শিশুর সুস্থ বৃদ্ধি এবং বিকাশের পরিবেশ নিশ্চিত করা সমাজের দায়িত্ব। সন্তান কোন ক্রীতদাস বা ত্যাগ করার জিনিস নয়, সে নিপীড়ন সহ্য করতে বাধ্য কোনো জীব নয়। প্রতিটি শিশু একটি আলাদা ব্যক্তিত্ব, যার জন্ম থেকেই সম্মান, ভালোবাসা এবং নিরাপত্তার অধিকার আছে।

.

একজন শিশুর সর্বাঙ্গীণ দায়িত্ব পালনে কেবল মা নয়, বাবাও সমানভাবে দায়বদ্ধ। যদি কেউ এই দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয় অথবা তার আচরণ থেকে এই অক্ষমতা প্রকাশ পায়, তাহলে এমন বিধান থাকা উচিত যে, সে সন্তানের জন্য পালনীয় সকল ধরনের দায়িত্বে আইনগতভাবে বাধ্য থাকবে এবং রাষ্ট্রের তদারকির আওতায় থাকবে। শিশুর অধিকার নিশ্চিত করা এবং তার রক্ষণাবেক্ষণে আদালতের আগে থেকেই সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ঠিক যেমন কারো শারীরিকভাবে প্রাণ নেওয়ার অধিকার নেই, তেমনি কারোর মানসিকভাবে ক্ষতি করার অধিকারও নেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই ধরণের অপরাধ আমাদের সমাজে প্রায়ই ঘটে থাকে।

.

পারিবারিক বর্বরতা কখনই পারিবারিক বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। এই ধরণের নাজুক বিষয়গুলি ফৌজদারি আইনের অন্তর্গত হওয়া উচিত। পারিবারিক আদালতের সিভিল প্রকৃতি এই সব বিকৃত আচরণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। যে সমাজে শিশুর জন্মনিবন্ধন থেকে শুরু করে সমস্ত আইডেন্টিটি কার্ডে মায়ের নামের আগে পিতার নাম উল্লেখ থাকে, কিন্তু সেই পিতা যখন সন্তানের দায়িত্ব পালনে অনুপস্থিত থাকেন, তখন মায়ের উপর এই বোঝা চাপে। সন্তানের প্রতি একটি পিতার বিমুখ আচরণ কেন সমাজে এত সহজে গৃহীত হয়?

.

একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেতে গেলে যোগ্যতা ও দায়িত্ববোধ দুটোই প্রয়োজন, কিন্তু একটি শিশুর জীবনে পিতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকার জন্য এই যোগ্যতা কিংবা দায়িত্ববোধের প্রয়োজনীয়তা কেন অবহেলিত হয়? যে পিতা তার সন্তানের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব অনুভব করেন না, তার উপর কেন সন্তানের অধিকারের দাবি থাকবে? যে সমাজ এই ধরণের পিতৃত্বকে স্বীকৃতি দেয়, তাকে কিভাবে সভ্য সমাজ বলা যায়?