শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নারীদের অধিকার যখন খর্ব হচ্ছে, তখন বিশ্লেষণে জানা যায়,‘নারী’ বলেই সে বঞ্চিত, নিপীড়িত। নারী নিপীড়ন বিভিন্ন ধরনের। কিন্তু সব নিপীড়নেরই কারণ একটি। আর তা হলো সে নারী আর নারী বলেই সে হবে নির্যাতিত। প্রচলিত সামাজিক বিশ্বাস ও কুসংস্কার নারীকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ রেখে প্রমাণ করতে চায়, নারী মানুষ নয়। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা পুরোপুরি সমাজ আরোপিত। সমাজ পরিবর্তনের জন্য নারীর সংগ্রাম তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনীতিজ্ঞ, রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী, অর্থনীতিবিদ, প্রশাসনিক, ব্যবসায়ী, অধ্যাপক, শিক্ষক, সাংবাদিক, সংগীতশিল্পী, চলচ্চিত্রশিল্পী, চিত্রশিল্পী, লেখক, গবেষক, চিকিৎসক, স্থপতি ইত্যাদি আরও বহু পরিচয়ে বাংলাদেশের নারীরা আজ সম্মানিত হচ্ছেন। অন্যদিকে জানা-অজানা বহু ধরনের নিপীড়নে নারীসমাজ ব্যাপকভাবে বিপন্ন। এ যেন ঠিক মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
একুশ শতকে এসেও বাংলাদেশের নারী নিপীড়িত হচ্ছে ‘নারী’ হিসেবেই। কিন্তু নারী নিপীড়নের জন্য পুরুষসমাজকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো নারী আন্দোলনের লক্ষ্য নয়। নারী নির্যাতক বা নিপীড়কের চেহারাটা পুরুষের হলেও পুরুষসমাজকে নারী নির্যাতনের জন্য দায়ী করা হয় না। রক্ষণশীল পুরুষ-আধিপত্য, পিতৃতান্ত্রিক এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ছাড়াও সমাজকাঠামো, রাষ্ট্রব্যবস্থা, আইন এবং মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি সবই কিন্ত নারী নির্যাতনের জন্য দায়ী। পুরুষ ও নারীর মিলিত প্রগতিশীল পদক্ষেপ পরিবর্তন করতে পারে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা। সেই পথেই নারীসমাজের বিপন্নতা দূর হতে পারে। আর সেজন্যেই নারীদের এই সংগ্রামটা চালিয়ে যেতে হবে।
পরিবার, সমাজ ও ব্যক্তি, প্রশাসন ও রাষ্ট্র সবই যেন নারীর জীবনের বিকাশ, আনন্দ ও প্রগতির বাধা হয়ে আছে একুশ শতকেও। প্রগতিবাদীরা নারীর সার্বিক বিকাশের জন্য শিক্ষা, জীবিকা, সংস্কৃতিচর্চা, সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালাচ্ছেন। মানবাধিকার অর্জনের আন্দোলনে নারী-পুরুষের সমঅংশগ্রহণের সংগ্রাম চলেছে। কিন্তু আশানুরূপ নারীবৈষম্য এবং নিপীড়ন বন্ধ হচ্ছে না।
নিত্য নতুন সংকটে, সমস্যায় নারীর জীবন জর্জরিত ও বিপন্ন হচ্ছে। এখনো একজন নারীকে শুনতে হয় সে কেন কালো? পাত্রপক্ষ কেন তাকে পছন্দ করে না? লেখাপড়া শিখিয়ে টাকা খরচ করেও তার জন্য কেন বিয়েতে যৌতুক দিতে হবে? স্বামীকে কেন বশে রাখতে পারে না? স্বামী কেন আনন্দ খুঁজতে পরনারীতে আকর্ষিত হয়? শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ পরিজনদের মন জুগিয়ে চলে না কেন? সন্তান হয় না কেন? ছেলেসন্তানের জন্ম দিতে পারছে না কেন? কন্যাভ্রূণ হত্যা করতে রাজি না কেন? শিক্ষিত-ডিগ্রিধারী হয়েও কেন চাকরি পাচ্ছে না? পথে-ঘাটে নিরাপত্তার জন্য তার সঙ্গে পাহারাদার লাগে কেন? ছেলেরা কেন তাকে উত্ত্যক্ত করে? পথে-ঘাটে, স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে, অফিসে-আদালতে, ট্রেনে-বাসে-লঞ্চে-বিমানে আলাদা টয়লেট, আলাদা আসন, বিশেষ বিশেষ ব্যবস্থা নারীর জন্য কেন করতে হবে? অন্তঃসত্ত্বাকালীন বিশেষ কয়েক মাস সবেতন ছুটি কর্মজীবী নারীদের কেন দিতে হবে?
কর্মক্ষেত্রে সন্তান রক্ষণাবেক্ষণকেন্দ্রের বিশেষ ব্যবস্থা কেন করতে হবে? নারী যদি শ্রমজীবী, পেশাজীবী, কর্মজীবী হতে পারে, তবে পুরুষের তুলনায় অন্য বিশেষ ব্যবস্থা তাকে কেন দিতে হবে? নাজুক শক্তি, মেধা-বুদ্ধি সত্ত্বেও নারী পুরুষের সমান বেতন-মজুরি দাবি করে কেন? সংসারে, কর্মক্ষেত্রে, রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে একজন নারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে ভূমিকা রাখতে চাবে কোন সাহসে?
পারিবারিক আইনে স্বামীর সমান অধিকার চাবে কেন নারী? কেন পুরুষ ও পুরুষতান্ত্রিকতার ক্ষমতার রাজত্বে নারী হয়ে সমান অংশীদার হতে চাবে একজন নারী? —প্রতিনিয়ত এ রকম হাজার হাজার প্রশ্নে নারীদের জর্জরিত হতে হচ্ছে। নারীকে প্রতিনিয়ত এ ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
প্রতিনিয়ত একজন নারীকে সমাজে, পরিবারে, আদালতে, সালিসি সভায় নকাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। ধর্ষণের মামলায় সাক্ষী আনার জন্য বলা হয় যে ঘটনায় ধর্ষিত নারীই একমাত্র সাক্ষী, পারিবারিক নির্যাতনের বিষয়েও সাক্ষী আনতে বলা হয় সেখানে শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতিত গৃহবধূ সাক্ষী পাবেন কীভাবে? বৈষম্য, শোষণ ও নির্যাতনের যাতাকলে বিপন্ন নির্যাতিত নারীকে প্রতিনিয়ত হারিয়ে যেতে হচ্ছে পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রীয় তথ্য থেকে।
নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নারীর সংগ্রাম চলছে। আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, আইনগত, পরিবেশগত সার্বিক পশ্চাৎপদ অবস্থান এবং সেসব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্যের নিরসনকল্পে চলেছে নারীর ক্ষমতায়নের সংগ্রাম। নারীর অবমূল্যায়নের পরিবর্তন চাওয়ার জন্য চলেছে নারীর সংগ্রাম। দরিদ্রতম নারীর অধিকার দাবি এবং অবস্থাপন্ন নারীর অধিকার দাবির মধ্যে মৌলিক অনেক পার্থক্য আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘নারীর সংগ্রাম’ সব স্তরের নারীসমাজকে একই প্রতিবাদে, মিছিলে শরিক করেছে। ‘নারী’ হিসেবে লাঞ্ছিত হচ্ছেন সব বিত্তের নারী। সেই লাঞ্ছনার অবসান ঘটানোর জন্য ‘নারী মানবাধিকার’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই চলেছে নারীর সংগ্রাম।