বাংলাদেশ একটি ইসলামিক দেশ এটা বলার আগে একটু ইতিহাস ঘটিয়ে নেয়া ভালো ! বাংলাদেশকে অসম্প্রদায়িক দেশ বলার অনেক বৃহৎ ঐতিহাসিক ঘটনা আছে। বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এবং বিভিন্ন উপজাতীয় ধর্ম বিরাজমান, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কাল থেকে এই অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশে ধর্মীয় বিরোধ দেখা দেয় । বলা বাহুল্য এটা ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের ‘মূলমন্ত্র‘ Divide and Rule –এর ফলাফল (Mandal, 2007) (Sarkar, 2020)। এরই মাঝে ১৯৪৭ সালে বঙ্গ–ভঙ্গ এর মধ্যে দিয়ে পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র এবং পূর্ব–বাংলা ( বর্তমানে বাংলাদেশ) অমুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে ভাগ হয়ে যায় । পরবর্তীতে বাঙালি জাতি নিজেদের ভাষা, স্বতন্ত্রতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ম্যাশ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করে ( Islam, 2018)। আমার মতে বাংলার হয়ে যারা যুদ্ধ করেছে তারা বাঙালি সত্তাকে ভালোবেসে লড়েছে কেননা যুদ্ধে হিন্দু, মুসলিম, খৃস্টান, বৌদ্ধ, উপজাতীয় ধর্মাবলম্বী সকলে অংশ নিয়েছে এবং ধর্ম সেখানে বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখেনি নইলে পাকিস্তানি মুসলিমদের বিরুদ্ধে বাঙালি মুসলিমের লড়তো না।
১৯৭২ এর বাংলা নতুন সংবিধানের ৪টা মূল কাঠামো হলো, গনত্রন্ত, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্র (Sarkar, 2020) কিন্তু ধর্ম সব সময়ই রাজনীতির মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে ( Islam, 2018)। যদিও শেখ মুজিবুর রহমান ধর্ম কে রাজনীতি থেকে বিরত রাখার পক্ষপাতী ছিলেন কিন্তু তার মৃত্যুর পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন এবং তখন থেকেই ইসলাম বাংলাদেশী রাষ্ট্র চালনায় মূল মন্ত্রে পরিণত হতে থাকে। উনি সংবিধান থেকে ‘ ধর্মনিরপেক্ষতা‘ মুছে দিয়ে ‘ পরম বিশ্বাস এবং আস্থার উৎস আল্লাহ‘ এবং ‘বিসমিল্লাহ–হির–রহমান–ইর–রাহিম‘ –এর সংযোজন করেন। এই সাংবিধানিক পরিবর্তনের পাশাপাশি অনেক ইসলামিক পদক্ষেপও গ্রহণ করে ( Islam, 2018)। পরবর্তীতে, এরশাদ হোসাইন ‘সাপে বর‘ হয়ে আসেন। উনি ইসলাম কে রাষ্ট্র পরিচালনায় আরো এগিয়ে নিয়ে যান (Sarkar, 2020), এর একটি উদাহরণ হলো– ১৯৮২ সালের শহীদ দিবস, যা পালিত হয় বাংলা কে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের শরণার্থে, এই বছর থেকে শুরু হয় যথাযোগ্য ইসলামিক ভাবগাম্ভীর্যে দোয়া মাহফিল ও কোরান থেকে সূরা পাঠের মদ্ধ দিয়ে যা এর আগে দীর্ঘ সময় জুড়ে পালিত হতো শহীদ মিনারে, রাস্তায়, বিভিন্ন স্থাপনায় আল্পনা অঙ্কনের মদ্ধ দিয়ে কিন্তু আল্পনাকে হিন্দু ধর্মাচরণ মনে করেই এই পরিবর্তন সংঘটিত হয় ( Islam, 2018)।
ধর্মের গুটি চেলে রাজনীতি খেলার ফসল জামাত–এ–ইসলামী এর মতো রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব এবং শেকড় গেড়ে শক্ত–পোক্ত ভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠা। তাদের পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব সবসময় লক্ষণীয় এবং সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীদের পাশবিকতা বলার অপেক্ষা রাখে না যে তারা বাংলাদেশকে ইসলাম ধর্মীয় গোড়ামিপূর্ণ একটি দেশে পরিণত করতে চায় ( Islam, 2018)। উন্নত মুসলিম রাষ্ট্র গুলো পৃথিবীটাকে তাদের ধর্মীয় আদর্শে পরিচালিত করার স্বপ্নেবিভোর এবং বাংলাদেশকেও তাদের পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করে তাই তাদের আর্থিক সহায়তায় মাশরুমের মতো গড়ে উঠেছে ঘরের আনাচে কানাচে অজস্ত্র মসজিদ মাদ্রাসা ( Islam, 2018)। ঠিক যেমন পর্তুগিজরা আমাদের মহাদেশে এসে ধর্ম প্রচার শুরু করে, গির্জা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে দিয়ে গেছে, কারণ তাদের মূল মন্ত্র ছিল আমাদের চিন্তাধারাকে তাদের চিন্তাধারায় রূপান্তর করা আর তারজন্য ধর্ম ও শিক্ষা তাদের হাতিয়ার ছিল। হিসাব মতে বাংলাদেশে এখন ৩ লক্ষ্য মসজিদ আছে, এরই অন্তরালে মৌলবাদী চিন্তাধারা আধ্যাতিকতাকে নিয়ে খেলা করছে। ইসলামিক বিপ্লবের আশায় মাথা চারা দিয়ে উঠছে জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), হিজব–উত–তাহরির বাংলাদেশ (এইচটিবি), জামাত–উল–মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) –এর মতো উগ্রপন্থী দল ( Islam, 2018)।
ইতিহাস তো ঘাটানো হলো এর পর আশা যাক বর্তমান দৃশ্যপটে ! বাংলাদেশী সরকার দ্বারা ধর্মীয় বৈষম্যের সব থেকে বোরো উদাহরণ হচ্ছে শত্রূ সম্পত্তি আইন যা পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পরও ১৯৭৪ এর আইন সংশোধনীতে অর্পিত সম্পত্তি নামে পূর্ণবহাল রাখা হয়। অমুসলিমদেরকে রাষ্ট্রের শত্রূ ঘোষণা দিয়ে তাদের সম্পত্তি সরকার এর মালিকানাধীন করার একটি অপূর্ব পন্থা। এই আইনের প্রকোপে ৫০ লক্ষ্য হিন্দু ধর্মাবলম্ব্বী ২০ লক্ষ্য একর জমি–জমা, সহায়–সম্পত্তি মালিকানাচ্যুত হয় (Gupta, 2018)। পৃথিবীর যেকোনো দেশে ইসলাম বিদ্বেষী কোনো ঘটনা ঘটলে তার ফল ভোগ করতে হয় বাঙালি অমুসলিম সংখ্যালঘুদের। গোপালগঞ্জের ক্যাথলিক চার্চ (২০০১), কক্সবাজারের রামু (২০১২), পাবনার সাঁথিয়া ( ২০১৩), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর (২০১৬), রংপুরের ঠাকুরপাড়া (২০১৭) এবং ভোলা (২০২০) ধর্মীয় সহিংসতারই উদাহরণ (Sarkar, 2020)। ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠীর এই চরমপন্থী আচরণ দিন দিন আরো ভয়ানক হয়ে দাঁড়িয়েছে (HAF, 2014)। ধর্ম যেহেতু রাজনীতির চাবিকাঠি তাই ২০০২, ২০০৮ এবং পরবর্তী সাধারণ ভোটাভোটির পরই আক্রমণ চলে দেশের বিভিন্নপ্রান্তে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর (Sarkar, 2020)| ২৮ শে ফেব্রুয়ারী ২০১৩ সালে, দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির পর সংখ্যালঘুদের প্রায় ১০০ ঘর–বাড়ি, কিছু মন্দির, ৫০ টি ব্যাবসায়িক স্থাপনা ভাঙচুর করা হয় ও আব্দুল কাদের মোল্লা‘র ফাঁসির পর ২৫–৩০ টি বসতবাড়ি ও দোকান–পাট ধ্বংস করা হয় (Sarkar, 2020) (BBC, 2013)। এছাড়াও ১২ ই এপ্রিল ২০২০ সালে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ১২টি ব্যাবসায়িক কেন্দ্র জোর দখল করা হয়, ২জন হিন্দু ব্যাবসায়ী খুন হয়, সংখ্যালঘুদের ৩০৭ একর জমি স্থানীয় সন্ত্রাসীরা দখল করে নেয়। ২১ টি হিন্দু পরিবারকে তাদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয় এবং আরো ১৪টি হিন্দু পরিবারকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। ১০ই এপ্রিল একজন খৃস্টান ব্যক্তির ৬বিঘা পৈতৃক সম্পত্তি দখল করা হয় | এবার দূর্গা পূজায় যা ঘটলো তা বঙ্গ ভঙ্গের সময়কালের কথা মনে করিয়ে দিলো। কোরান অবমাননার গুজবে প্রায় ১০০টি মন্দির ও পূজামণ্ডপ ভাঙচুর, হিন্দু ঘর–বাড়ি, দোকানপাট জ্বালিয়ে দেয়া, সাতজন প্রাণ হারায় ও একটি বৌদ্ধ মঠ আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হয় ( HASAN, 2021)। এইসকল ধর্মীয় সহিংসতার বিরুদ্ধে যেই প্রতিবাদ করবে তাকে চরম ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, যেমন ধর্মীয় অন্ধত্ব নিয়ে, মানবাধিকার নিয়ে ব্লগে লিখালিখির ফলে চাপাতির আঘাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাস, নিলয় চক্রবর্তীর মতো মেধাবী হিন্দুদের।
References
HASAN, M., 2021. Minorities under attack in Bangladesh. [Online]
Available at: https://www.lowyinstitute.org/the-interpreter/minorities-under-attack-bangladesh
[Accessed 16 December 2021].
Islam, M. M., 2018. SECULARISM IN BANGLADESH: AN UNFINISHED REVOLUTION. SOUTH ASIA RESEARCH, 38(1), pp. 20-39.
BBC, 2013. Attacks on Bangladesh minority communities ‘continue. [Online]
Available at: https://www.bbc.co.uk/news/av/world-asia-21711785
[Accessed 15 november 2021 ].
Gupta, A., 2018. Population Projections and Minorities:. A Case Study of Bangladesh, 23(1), pp. 46-55.
HAF, 2014. Bangladesh at a Crossroads: Policy Brief 2013–2014. [Online]
Available at: https://www.hinduamerican.org/sites/default/files/BangladeshPolicyBrief2013.pdf
[Accessed Monday November 2021].
Mandal, G., 2007. Treatment of Law to the Minorities in Bangladesh: Rhetoric and Reality, Dhaka: Human Rights and Corruption. Dhaka, Empowerment through Law of the Common People.
Sarkar, A., 2020. Victimization of religious minorities in Bangladesh, Dhaka: academia.