.

.

আমরা যদি নিজেদের নির্বিকার ভাবে আলাদা রাখি এবং বলি যে আমার দেশে এমন ভয়ানক কিছু হতে পারে না, তাহলে আমরা নিজেরাই আতঙ্কের গভীর খাদ সৃষ্টি করব। এখন আমাদের দেশ হয়ে গেছে ধর্মান্ধদের আদর্শ ভূমি, আমরা চাই বা না চাই।

.

অভিজিৎ রায় বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান ও মানবতাবাদ সম্পর্কে সহজ ও বোঝার উপায়ে বই লিখে বাংলাদেশের মানুষের জ্ঞানের জানালা খুলতে চেয়েছেন। তাঁর প্রচেষ্টা ছিল মানুষকে পথ দেখানো যাতে তারা আলোর দিকে এগিয়ে যায়। তিনি যখন বাংলাদেশে এলেন, তখন এই দেশ তাঁকে বিদ্রোহী অন্ধকারের দ্বারা বরণ করে নিয়েছিল, যেখানে তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।

.

প্রফেসর জাফর ইকবাল একইভাবে বিজ্ঞান ও কল্পকাহিনী বাংলায় লিখে যুব সমাজকে শিক্ষিত করার চেষ্টা করেছেন। তিনিও বিদেশে থাকতে পারতেন, কিন্তু দেশে ফিরে এসেছিলেন দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে। আমরা, দেশের মানুষ, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখিয়েছি তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা করে। যে আক্রমণের বিরুদ্ধে লেখা ঘৃণ্য মন্তব্যগুলো আমাদেরই এক অংশ, তারা আমাদের আশেপাশে এবং আমাদের ঘরেরই মানুষ।

.

এই ঘটনাবলী আমাদের দেখায় যে আমরা কতটা অসহিষ্ণু এবং ভয়ানক হতে পারি। যারা আলো প্রদান করতে চায়, নতুন ভাবনা এবং চিন্তা সামনে আনতে চায়, তাদের আমরা নির্মমভাবে প্রত্যাখ্যান করি। আমরা ভুলে যাই যে, নতুন চিন্তা এবং প্রগতিশীল মনোভাব হলো সমাজের উন্নতির চাবিকাঠি। যখন আমরা মেধা এবং বুদ্ধির কথা উপেক্ষা করি, আমরা শুধু নিজেদেরই ক্ষতি করি, সমাজকেও পিছিয়ে দেই।

.

অভিজিৎ রায় এবং প্রফেসর জাফর ইকবালের মতো মানুষেরা আমাদের সমাজে বিরল, যারা তাদের জ্ঞান এবং বুদ্ধির প্রয়োগ দিয়ে আমাদের জন্য ভালো কিছু করতে চান। তাদের কাজ অনুপ্রেরণাদায়ক এবং তাদের উদ্দেশ্য ছিল সমাজের জন্য ভালো কিছু করা। কিন্তু যখন আমরা তাদের উপর আক্রমণ করি, তখন আমরা না কেবল একজন ব্যক্তির প্রতি অবিচার করি, বরং সম্পূর্ণ সমাজের প্রতি অন্যায় করি।

.

যে দেশ অভিজিৎ রায়কে বাঁচাতে ব্যর্থ হল, জাফর ইকবালকে সুরক্ষা দিতে অক্ষম রইল, সে দেশ মুন্সীগঞ্জের শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে তার কাজে সমর্থন দেবে কিভাবে, তা আশা করা কঠিন। নির্লিপ্তি ও অন্যায়ের প্রতি আমাদের বোধ এখন যেন মোহাচ্ছন্ন। আমাদের প্রতিবাদ শুধু ভার্চুয়াল জগতে সীমাবদ্ধ, বাস্তবে নীরব।

.

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের অভাব নতুন নয়। ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে গড়া দেশটি ক্রমে ধর্মীয় পরিচিতির চাদরে মোড়া হয়েছে। আমাদের প্রতিবাদের অভাবে এই অন্ধকার গভীরভাবে দেশের মূল অস্তিত্বকে গ্রাস করেছে। ১৯৭৫ সালে যখন সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল, বা যখন মেজর জিয়া ও এরশাদ সংবিধানে ধর্মীয় পরিচয় সংযোজন করলেন, তখন ধর্মনিরপেক্ষতার পথ থেকে আমরা সরে এলাম। যখন রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের প্রতিষ্ঠা সংবিধানে খোদাই করা হল, তার বিরুদ্ধে সমাজের প্রতিক্রিয়া অপ্রতুল ছিল।

.

এই পর্যায়ে এসে, আমাদের বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি বিরাজমান তা হলো অন্ধকার ও নৈরাজ্যের এক ভয়াবহ চিত্র। যেখানে একজন মুক্তমনা লেখক বা একজন নিরীহ শিক্ষকের মুক্ত চিন্তা এবং সত্য উচ্চারণের জন্য সাজা পেতে হয়, সেখানে সমাজের উন্নয়ন এবং প্রগতির পথ কেমন করে সুগম হবে? ধর্মীয় মৌলবাদ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার মিথস্ক্রিয়ায় একটি দেশের মৌলিক গঠনতান্ত্রিক মূল্যবোধ যখন বিকৃত হয়, তখন সে দেশের জনগণের চিন্তার স্বাধীনতা কী করে রক্ষা পাবে?

.

আমাদের দেশ যখন শিক্ষকের জেলে যাওয়া বা লেখকের খুন হওয়ার খবরে অবিচল থাকে, তখন এই স্থবিরতাই আমাদের প্রতিফলিত হয় এক গভীর নির্লিপ্ততায়। ফেসবুকে আমরা যতই প্রতিবাদের ঝড় তুলি না কেন, বাস্তবে আমাদের সক্রিয় প্রতিবাদ অপ্রতুল। আমাদের আত্মপ্রশ্ন হওয়া উচিত, আমরা কি সত্যিই নিজেদের এবং আগামী প্রজন্মকে মুক্তমনা চিন্তার জন্য প্রস্তুত করছি?

.

মুক্ত চিন্তার পথে যাত্রা কঠিন হলেও, সেই যাত্রায় অবিচল থাকার বিকল্প নেই। এই অবিচল পথ চলাই আমাদের সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যেতে পারে, মুক্ত চিন্তা এবং সত্য উচ্চারণে উৎসাহিত করে। আমাদের দায়িত্ব হলো এই প্রয়াসে অটল থাকা, নিজেদের মানসিক দৃঢ়তা বাড়িয়ে তোলা এবং পরবর্তী প্রজন্মকে একটি উদার, মুক্ত এবং প্রগতিশীল সমাজের জন্য প্রস্তুত করা।