আজকের নারীরা চার দেয়ালের ঘেরাটোপ ভেঙে পুরুষের সঙ্গে সমানতালে অফিস-আদালতে কাজ করছেন। ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকে ব্যবসা বাণিজ্যসহ নানান আয়বর্ধক কাজে অদম্য উৎসাহে এগিয়ে চলার চেষ্টা করছেন। নারীরা এখন পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হিসেবে নিয়োজিত। এতকিছুর পরেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এখনো বদলায়নি নারীদের প্রতি পুরুষের মানসিকতা। এ কারণেই কর্মক্ষেত্রে নারীরা এখনো নিপীড়নের শিকার হন, মুখোমুখি হন ব্যক্তিগত নানা বিড়ম্বনার। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দীর্ঘ এই সময়েও সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা-বিড়ম্বনা কর্মজীবী নারীদের পিছু ছাড়ছে না। নারীদের নানাক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা ও বিড়ম্বনার শিকার হওয়ার এই চিত্র প্রায় সর্বক্ষেত্রে। মফস্বল এলাকায় এই চিত্র যেন আরও বীভৎস।
আজকের নারী পুরুষের পাশাপাশি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিচ্ছে। কিন্ত তার জন্য এই পথচলাটা খুব একটা সহজ নয়। একজন নারী সাংবাদিক হিসেবে, বিদ্যমান বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার-অপসংস্কৃতি দূর করার আন্দোলনে অংশীদার হতে কলম যোদ্ধা হিসেবে পথচলা শুরু করলেও আর এই পথচলার দীর্ঘ সময় পেরিয়ে আসার পরেও তাকে সামাজিক বিড়ম্বনায় পরতে হয়। এর থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারা তার জন্য সহজ নয়। এই পথচলায় ব্যক্তিগত জীবনে তাদেরকে অসংখ্য তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এছাড়াও পেশাগত জীবনের পথচলায় একটা ভালো অবস্থানে যেতে তাকে সহ্য করতে হয় অনেক কষ্ট, পোড়াতে হয় অনেক কাঠখড়। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা গিলে খেয়ে, বৈরিতার সাথে লড়তে লড়তে তারা নিজের একটা অবস্থান তৈরী করতে পারে।
কর্মক্ষেত্রে কুদৃষ্টি, গায়ে ধাক্কা, অশ্লীল ইশারা, কুপ্রস্তাব, অশ্লীল কথাবার্তা—এ ধরনের অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে হয় একজন নারীকে। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে অফিসের বড় কর্মকর্তারা নানা অজুহাতে তাদের কক্ষে ডেকে পাঠান। আকার-ইঙ্গিতে নানা কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেন। বুঝলে বিপদ, না বুঝলেও বিপদ। পুরুষ সহকর্মীদের দ্বারা নানা ধরনের গসিপ, কানাকানি, কথা লাগানো এতো যেনো নিত্য ঘটনা। বস ও সহকর্মী দ্বারা হয়রানির শিকার হতে হয় অনেক কর্মজীবী নারীকে। ঘটে যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনা। আর এসব কারণে যথেষ্ট যোগ্যতা সম্পন্ন অনেক নারীকেই শেষমেশ চাকরিটাই ছেড়ে দিতে হয়।
কর্মক্ষেত্রে বিড়ম্বনার পাশাপাশি একজন নারীকে বৈষম্যের শিকার হতে হয়। এই বৈষম্যের ফলে নারীরা কাজ কম পাচ্ছেন। যেসব নারী কাজ পাচ্ছেন, তারাও খুব মানসম্পন্ন কাজ পাচ্ছেন না। একই মানের কাজ করেও কর্মক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের তুলনায় কম পারিশ্রমিক পাচ্ছেন। মেধা, যোগ্যতা আর দক্ষতার বিচারে পুরুষদের সমকক্ষ নন নারীরা—এমনটাই মনে করা হয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে। একজন নারীকে তারা ততক্ষণ সহ্য করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি তার ওপরে না ওঠেন। যখনই ওপরে উঠতে যান,তখনই শুরু হয় দ্বন্দ্ব ও নানা সমস্যা। এমনকি তখন তাদেরকে চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা হয়।
একজন নারী যখন শিক্ষিকার ভূমিকায় থাকেন এবং শিক্ষকতার পাশাপাশি সৃষ্টিশীল কাজের প্রতি আগ্রহী হন, হতে পারে তিনি কবিতা লেখেন কিংবা আবৃত্তি করতে ভালোবাসেন। এখন চাইলেই কি তিনি চাকরির পাশাপাশি মননশীল এই ধরনের কাজে বাড়তি সময় ব্যয় করতে পারেন? পরিবারের নানান বাধা আর কৈফিয়ত তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। অপরদিকে এই একই পেশায় থাকা একজন পুরুষ কিন্ত চাইলেই নিজের শিক্ষকতা পেশার পাশাপাশি নিজের সৃষ্টিশীল কাজেও সমানহারে মনোনিবেশ করতে পারে। এর কারণ হচ্ছে তাকে ঘরের কাজ নিয়ে ভাবতে হয় না। সেই ভাবনা এককভাবে একজন নারীকেই ভাবতে হয়। এযেনো একটি অলিখিত নিয়ম।
এই সমাজের পুরুষরা নারীদের চাওয়া-পাওয়ার কোন মূল্যায়নই করতে রাজি নয়। পুরুষরা নারীদের প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে হয়রানি করে চলেছে। তারা নারী সহকর্মীদের কোন ধরনের সহযোগীতা তো করতেই চান না উপরন্তু টেলিফোন, এসএমএস অথবা ই-মেইলের মাধ্যমে হয়রানি করে বেড়ান।
সমাজে পরিবর্তন আনতে কিংবা নারীদের স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করার পরিবেশ দিতে হলে, সবার আগে পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি বা মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে, তা না হলে এটি কখনোই সম্ভব নয়। নারীদেরও সচেতন হতে হবে। কোনো সমস্যা হলে সেটি নিয়ে চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। এ ক্ষেত্রে একজন নারী যেই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে সেই প্রতিষ্ঠানকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে।
কর্মক্ষেত্রে নারী নির্যাতন বা নিপীড়ন বন্ধে আইন আছে, এর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নিপীড়নের বিষয়ে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে পলিসি থাকতে হবে, নারীরা যাতে অভিযোগ করতে পারেন ও তাকে যেন এ আশঙ্কা না করতে হয়, অভিযোগ করলে চাকরি চলে যাবে। এক্ষেত্রে মিডিয়ারও একটি জোরালো ভূমিকা আছে। মিডিয়া কর্মক্ষেত্রে নারীদের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরতে পারে। নারীর কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে কর্মক্ষেত্রে নারীর বিড়ম্বনার কোন সমাধান কখনোই হবে না।