আপাতদৃষ্টিতে গত দুইশো বছরে নারীর অনেক অর্জন আছে। তারপরও পুরুষতন্ত্রের সর্বগ্রাসী ও কর্তৃত্ববাদী সমাজ নারীকে সব সময়ই পেছনে টেনে ধরে রাখছে এবং ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা এখনো চালাচ্ছে।
আমরা যদি পুরুষতন্ত্র নিয়ে কথা বলতে চাই তাহলে প্রথমেই আমাদের ‘তন্ত্র’ কথাটির মানে জানতে হবে। ‘তন্ত্র’কথাটির আভিধানিক অর্থ ব্যবহার, নিয়মাদি, পরিবীক্ষণ বা শাসন। মানুষ যখন দলবদ্ধ হয়ে থাকতে শুরু করল অর্থাৎ গোষ্ঠী বা দল তৈরি করল, তখন থেকেই কোনো না কোনো তন্ত্রের অধীনে সমাজবদ্ধ হতে শুরু করে। গোষ্ঠীতন্ত্র থেকে ধীরে ধীরে সেটা মাতৃতান্ত্রিক বা মাতৃসূত্রীয় সমাজের উত্তরণ ঘটায় এবং এরপর নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়।
পুরুষতন্ত্র মূলত মেয়েদের যোগ্যতা ও দক্ষতা স্বীকার করতে চায় না। তাদের অধিকার ও কর্তৃত্ব যেন কোনভাবেই মেনে নিতে পারে না। নিজের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা অটুট রাখতে তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে। নারীর কৃতিত্ব কৌশলে অস্বীকার করা পুরুষতন্ত্রের এক নতুন কৌশল। অনেকে অবশ্য নিজস্ব নির্বুদ্ধিতারর কারণেই নারীর কৃতিত্বে বিস্ময় প্রকাশ করেন। ঐ বিস্ময় আসলে আসলে উদ্দেশ্যমূলক এবং মিথ্যা। সত্য এই যে, নারীর সাফল্যে বিস্ময়ের কোন কারণ নেই। নারী যা অর্জন করে তা নিজের যোগ্যতা বলেই অর্জন করে এখানে তার অর্জনে বিস্ময় প্রকাশ কিংবা তার অর্জনকে ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই।
পুরুষতন্ত্র নারী নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের দায় চাপিয়ে দেয় খোদ নারীদের উপরেই। এই ভাবে সে নিজের কৃতকর্মের দায়ভার এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। কথায় কথায় সামাজিক স্থিতি এবং পবিত্রতার অজুহাত খাড়া করে নারীদের দায়ী করতে তৎপর হয়। সেই দোষারোপে তার সহায় হয় দীর্ঘকালের লালিত সামাজিক ধারণা, যে ধারণা বহুলাংশে পুরুষতন্ত্রেরই অবদান। আর অন্যায়ের দায় অন্যের ঘাড়ে না চাপাতে পারলে সেই অন্যায়ের দায়ভার নিতে হবে এবং সর্বোপরি নিজের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। সেই জবাবদিহিতা হয়তো পুরুষতন্ত্রের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে। তার চাইতে দোষ নারীদের ঘারে চাপানোকেই তারা শ্রেয় মনে করে।
পুরুষতন্ত্র ক্ষমতার তন্ত্র। আর ক্ষমতা নিজেকে প্রশ্ন করতে চায় না। এটা অবশ্য ক্ষমতারই স্বভাব। ঘরে বা বাইরে, ক্ষমতা কোনো অবস্থাতেই নিজের দায় স্বীকার করতে চায় না। আবার সেই কারণেই ক্রমাগত ক্ষমতাতন্ত্রকে কঠিন প্রশ্নের মুখে ফেলা দরকার। মেয়েদেরকে পুরুষের তুলনায় অক্ষম, হীন করে দেখার– মেয়েদের লাঞ্ছনার জন্য মেয়েদেরই দায়ী করর যে কোনো চেষ্টাই আসলে প্রবল প্রতিবাদের যোগ্য। যেটা আদতে করা হয় না।
পুরুষতন্ত্র নারীকে গৃহে বন্দী করেছে, তাকে সতীত্ব শিখিয়েছে, সতীত্বকে নারীর জীবনের মুকুট করে তুলেছে, যদিও লাম্পট্যকেই করে তুলেছে নিজের গৌরব। সমাজের সব মূল্যবোধ, আইন, নীতি, ধর্ম, নিয়ম পুরুষদের সৃষ্টি, পুরুষতান্ত্রিকতার ফল। ‘সতীত্ব’ বা ‘ভার্জিনিটি’ তকমাটা পুরুষশাসিত সমাজই নারীদের দিয়েছে।
পুরুষতন্ত্রের আক্রমণের নতুন বিষয়বস্তু হয়েছে নারীর পোশাক। বর্তমানে নারী নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাককেই সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়। অথচ সভ্যতার মৌলিক একটি সূত্র, অন্যের উপস্থিতি, অন্যের স্বাধীনতা এবং অন্যের ইচ্ছাকে স্বীকার করে নেওয়া। নারী কেমন কাপড় পরবে– এটা একান্তই তার নিজস্ব বিষয়, ব্যক্তিগত বিষয়।
নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে নারীরা আজকাল বাইরের কাজের জগতে প্রবেশ করেছে। নারীর স্বনির্ভরতা পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে বিপন্ন করে তুলছে। নারী হয়ে উঠেছে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী। এই অবস্থায় পুরুষতন্ত্র সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। আবারও পুরুষতন্ত্র পুরনো অস্ত্র নতুন করে শাণ দিয়ে মাঠে নেমেছে। এই অস্ত্রের নাম হল নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ও যৌন-সন্ত্রাস। নারীর নিরাপত্তা, আত্মসম্মান, স্বাধীন চিন্তার সুযোগ কেড়ে নিলেই কেবল পুরুষ নিশ্চিন্ত হতে পারে এবং তার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো যৌন-হিংসা। একজন নারী কেবল পুরুষকে ‘সুখ দেবার একটা শরীর, তার বেশি কিছু নয়’– পুরুষের এটা বারবার মনে করার এবং মনে করাবার প্রয়োজনীয়তা এখন তীব্র। নারীকে গায়ের জোরে অসহায় করে ফেলতে পারলে একদিকে তার ‘স্পর্ধা’ গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়, অন্যদিকে ‘পৌরুষের’ তীব্র মনোবেদনা কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়।
ঘরে-বাইরে নারীর উপর আগ্রাসী যৌন আচরণ, যৌন হয়রানি, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ সবই পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোতে নারীর অধস্তনতাই প্রকাশ করে। দৃষ্টিভঙ্গিটা পুরুষতান্ত্রিক বলেই নারীকে তারা গণ্য করে অধস্তন আর ভোগের বস্তু হিসেবে– যা লেহনযোগ্য, পীড়নযোগ্য, নিপীড়যোগ্য।