পোশাক আমাদের সংস্কৃতির অংশ আর পোশাক হিসেবে শাড়ি বাঙালি নারীদের ঐতিহ্য, তাদের পরিচয়। বহুকাল আগে থেকেই বাঙালি নারীরা শাড়ি পড়ে আসছে। ইদানীংকালে অনেকের যুক্তি হিজাব আমাদের ধর্মের পোশাক। কিন্ত এই যুক্তির আগে অর্থাৎ ধর্মের আগে আমরা জেনেছি আমাদের সংস্কৃতি কী, আমাদের ভাষা কোনটি এবং কী আমাদের ঐতিহ্য। আর তখনই আমরা জেনেছি হিজাব আমাদের পোশাক নয়। এটি আমাদের পরিবারের পোশাক নয়, আমাদের সমাজের পোশাক নয়। হিজাব এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রেরও পোশাক নয়।
অবশ্যই হিজাব একটি বিজাতীয় সংস্কৃতি। কোনো একজন বিখ্যাত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব বলেছেন, ‘হিজাব বিজাতীয় হলে জিনস-টপসও বিজাতীয়।’ কথাটি আংশিক সত্য কেননা হিজাব আমাদের মধ্যে যে বিভাজন ঘটাচ্ছে, জিনস-শার্ট তা করতে পারেনি। হিজাব বলে দিচ্ছে, আমি বাংলাদেশের মুসলিম নারী এবং হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান বন্ধুদের থেকে আমি পৃথক। বলা বাহুল্য, হিজাব যতটা না ধর্মীয় পোশাক তার চেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক। এভাবেই হিজাব খুব কৌশলে সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করছে।
যারা বলেন হিজাব কিংবা বোরকা আমাদের ঐতিহ্য তাদের জেনে রাখা উচিৎ, হিজাব কিংবা বোরকা কোনোকালে আমাদের ছিলই না, বরং এর এই ব্যবহার দিন দিন আমাদের পৃথকিকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এটা শুধু ধর্মকে একটা রাজনীতিকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা নয় বরং ধীরে ধীরে আমাদের সংস্কৃতি লুপ্ত করারও একটা সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া যা প্রায় সফলতা লাভ করছে।
ভারতের কর্ণাটকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধ করার পর এক নারী শিক্ষার্থীর প্রতিবাদ ভাইরাল হওয়ার পর বাংলাদেশের একটি মেডিক্যাল কলেজের হিজাবের বিষয়টি নিয়েও কথা উঠেছে। যশোরে আদ্-দ্বীন সকিনা মেডিকেল কলেজে অমুসলিম শিক্ষার্থীদেরকেও বাধ্যতামুলক হিজাব পড়তে হয়। সেখানে ড্রেস কোড হিসেবে হিজাবকে বেছে নেয়ায় সব ধর্মের শিক্ষার্থীরা তা পরতে বাধ্য হচ্ছেন। ভর্তির সময়েই হিজাব পড়ার বিষয়ে লিখিত ‘সম্মতি’ নেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ। তবে এই অভিযোগ তাদের জানানো হলে, কর্তৃপক্ষ একে হিজাব না বলে প্রতিষ্ঠানের ‘ড্রেস কোড’ হিসাবে আখ্যা দিচ্ছে।
উক্ত কলেজের হিন্দু ধর্মাবলম্বী এক ছাত্রীর কাছে জানা যায়, তাদেরও হিজাব পরেই ক্যাম্পাসে যেতে হয়। কারণ ভর্তির সময়ই ছাত্রীদের থেকে স্বাক্ষর নেয়া হয়েছিল যেন ড্রেস কোড মেনে চলে। এজন্য চাইলেও তাদের প্রতিবাদ করার কোন সুযোগ নেই।
অভিযুক্ত মেডিকেল কলেজটি বলছে, এটি তাদের প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত। সবাই এটি মেনে নিয়েই সেখানে পড়াশোনা করছে। তবে এমন সিদ্ধান্ত কোনো প্রতিষ্ঠান নিতে পারবে না বলে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। এবং ২০১০ সালের ৪ অক্টোবর হাইকোর্ট এক রায়ে বলেছে, বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে কোনো ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা যাবে না। অথচ হাইকোর্ট এমন রায় দেওয়ার পরেই সেই প্রতিষ্ঠানটি তাদের স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়েই যাচ্ছে। সেসব মনিটর করার কেউ নেই। কেউ যেচে পরে ধর্মীয় বিবাদ বাড়াতে চায় না। অথচ অন্য ধর্মালম্বীরা এই ধরনের নিয়মের যাতাকলে ঠিকই পিষ্ট হচ্ছে।
এবার আসা যাক হিজাব কেন পড়ছে নারীরা সেই আলোচনায়। মূলত, বাধ্যবাধকতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা এ দুই কারণে নারীরা হিজাব পরছেন। পরিবারের চাপে বেশিরভাগ মেয়েরা হিজাব পরছে। পরিবারও যতটা না ধর্মের কারণে তাদের মেয়েদের হিজাবি বানাচ্ছে, তার চেয়েও বেশি নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে তাদেরকে হিজাব পরতে বাধ্য করা হচ্ছে। তবে প্রমাণিত হয়েছে এটাও যে, হিজাব মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে পারে না। সোহাগী জাহান তনুর মৃত্যুই তার প্রমাণ।
এখন আমাদের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে ধর্মের কারণে হিজাব পরছে শতকরা কজন? আমার মতে, শতকরা ৩০ জনও নয়।
আর স্বতঃস্ফুর্তভাবে হিজাব পরার পিছনে ‘পিয়ার প্রেসার’ কাজ করছে প্রচণ্ডভাবে। মেয়ে স্কুলের কারণে হিজাব পরছে, সে কারণে মা-ও পরছে। মা পরছে দেখে খালা পরছে, খালা পরছে দেখে মামি পরছে। এক বান্ধবী পরছে, অন্য বান্ধবী অনুপ্রাণিত হচ্ছে। স্কুলের সামনে মায়েদের আড্ডায় এসে কোনো নারী হিজাবের বয়ান করল, হিজাব পরার প্রতিযোগিতা শুরু হলো। আর হিজাবকে ফ্যাশনবল করার জন্য বাজারে এসেছে নানান ধরনের একসেসরিজ। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের চাইতে হিজাব এখন ফ্যাশনের অংশ হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে।
আমরা এখন সত্তর দশকের আফগানিস্তান বা ইরানের নারীদের স্বাভাবিক পোশাকের ছবি দেখে অবাক হয়ে যাই। যে হারে হিজাবের ব্যবহার বাড়ছে তাতে করে হয়তো নিকট ভবিষ্যতে হিজাববহীন বাঙালি নারীর ছবি দেখে বিশ্বের অন্য প্রান্ত বা নিজভূমির আগামী প্রজন্মের কেউ ঠিক একইভাবে অবাক হয়ে যাবে।