যে কোনো ধর্ম মানুষের মনে শেকড় গেড়ে শক্ত–পোক্ত ভাবে বাসাবেঁধে নেয়, সেটা যতটা না বিশ্বাসের জন্য তার থেকেও বেশি ভয়ের জন্য। সৃষ্টিকর্তাকে মানুষ যতটা না বিশ্বাস করে তার থেকেও বেশি ভয় পায় অজানা সত্যকে। ঈশ্বর আছে না নেই এর থেকে বেশি মানুষের মনে কাজ করে এই ভয় যে যদি ঈশ্বর নারাজ হয়ে যান আর শাস্তি দেন ! মৃত্যুর পর নরক বা দোজখে যাবার ভয়। মূলত এইসব ‘অজানা সত্যের‘ ভয় থেকেই মানুষ ধর্মে বিশ্বাস করে, কেননা কোথায় আছে, ‘নাই মামার থেকে কানা মামা ভালো!” অবিশ্বাস করে শাস্তি পাওয়ার থেকে বিশ্বাস নাহয় করলাম! কিন্তু তাতেও তো শান্তি নেই, সঠিক ধর্মে বিশ্বাস না করলে যে শেষে ওই নরকেই পুড়তে হবে! মানুষের মনে ধর্মের প্রতি ভয়ের থেকে ভালোবাসা বেশি কাজ করলে মানুষ ধর্ম নিয়ে হিংসাত্মক হয়ে উঠতো না ! নরক বা দোজখে যাবার ভয়টাই বেশি তাই কিনা অন্ধের মতো ধর্মের পুঁথিগুলো ‘ধর্মভীরুরা” পালন করার চেষ্টা করে! নিম্নে একটি ধর্ম গ্রন্ধের কিছু ধর্মীয় আদেশ বা ‘শিক্ষা‘ তুলে ধরলাম :
”যারা আল্লাহ‘র পথে শহীদহয়, আল্লাহ কখনোই তাদের কর্ম বিনষ্ট করবেন না (৪৭: ৪), যারা আল্লাহ‘র পথে নিহত হয়, তাদেরকে তুমি কখনো মৃত মনে করো না (৩: ১৬৯); যদি আল্লাহ‘র পথে কেউ যুদ্ধ করে মারা যায়, তার জন্য রয়েছে জান্নাত (৯ : ১১১)” (Roy, 2014)। এইসবের পাশাপাশি উত্তেজনা বর্ধকে কাজ করে যারা আল্লাহ‘র পথে শহীদ হবে তারা জান্নাতে গিয়ে কেমন পুরুষ্কার পাবে তার বর্ণনা। যেমন, তাদের জন্য থাকবে, ”আয়তলোচনা রমণীগণ (৫৫: ৫৬), সুশুভ্র (৩৭: ৪৬), উদ্যান, আঙ্গুর, পূর্ণযৌবনা তরুণী এবং পূর্ণ পানপাত্র (৭৮: ৩৩– ৩৪), আবরণে রক্ষিত মোতির ন্যায় (৫৬: ২২–২৩) চিরকুমারী (৫৬: ৩৫–৩) হুরিরা। ব্যবস্থা রেখেছেন গেলমানদেরও, সেই যে সুরক্ষিত মতিসদৃশ কিশোররা তাদের খেদমতে ঘুরাফেরা করবে (৫২: ২৪)” (Roy, 2014)
Arthur Jeffrey তার The Quran as Scripture (1952) বইয়ে লেখেন, ”মুহাম্মদ অন্তত হলেও এই ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যে পুরো আরব আল্লাহ‘র ভূমি হবে, সে লক্ষে জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন । যিহুদি ও খ্রীষ্টানরা আরবদেশে থাকতে পারবে কিন্তু ইসলাম এর অধীনতায়। যেহেতু আরববাসি এই সিদ্ধান্ত সহজে মেনে নেয়নি, তাই এটা তাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দিতে হয়েছিল, যার অর্থ হলো যুদ্ধ। কিন্তু যে যুদ্ধ আল্লাহ‘র নাম করা হয় সে যুদ্ধ যুদ্ধ নয়, সেটা ‘পুন্য যুদ্ধ‘।”
Richard Bell তার The Quran Volume (1937) – এ বর্ণনা করেন সূরা ৯ ” এই অধ্যায় হলো যুদ্ধের ঘোষণাপত্র”, শ্লোক ৯ .২৯ থেকে ৯.৩৫ বিশেষভাবে, ”প্রভাবিত করে যিহুদি ও খৃস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা, এটা হিজরা এর ৯ বছর পরের সমকালের যখন উত্তর দিকের জন্য একটি অভিযান পরিকল্পনা করা হয় যা হতে পারে খৃস্টানদেড় বিরুদ্ধে, হয়তোবা যিহুদিদের বিরুদ্ধেও। ” তিনি আরো লিখেন যে, ”মোহাম্মদের সময়ের লোকেরা কোনো অদ্ভুৎ কোনো কিছু দেখতো না মুহাম্মাদের মধ্যে, এমনকি আল্লাহ‘র বান্দাদের প্রধান হিসেবে আল্লাহ‘র রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশে, আরব রাজ্যে বসবাসকৃত সকলকে তার বশ্যতা স্বীকার করানোর জন্য তলোয়ার হাতে তুলে নেয়াটাও স্বাভাবিক। ”
আল–তাবারী, মুসলিম ইতিহাসবিদের সূত্রমতে, উমার–আল–খাত্তাব আল–বাসরাহ তে যে সৈন্যদল পাঠিয়েছিলেন ইরাকের আক্রমণের সময় তাদের প্রধানকে বলেছিলেন, ” জনগণকে আল্লাহ‘র দিকে আহব্বান করো। যারা তোমাদের ডাকে সারা দিবে তাদের গ্রহণ করো, কিন্তু যারা প্রত্যাখ্যান করবে তাদের জনকর শোধ করতে হবে অপমান আর নতমস্তকের সাথে। সেটাও তারা প্রত্যাখ্যান করলে তোমাদের তরবারি তা প্রশ্রয় দেবে না। ” (Bostom, 2010)
শাইখ বুরহানুদ্দিন তার ‘হিদায়াহ‘ (2010) –তে লিখেছেন, ‘যে কোনো জনগোষ্ঠীর ওপর যুদ্ধ ঘোষণা করা আইনানুগ হবে না যদি না তাদেরকে ইসলামের প্রতি প্রথমে আহব্বান না করা হয়ে থাকে। কারণ নবী তার সৈন্যদলকে সেটাই আদেশ দিয়েছিলেন, যেন অবিস্বাসীদেরকে বিশ্বাসের পথে ডাকা হয়, তাহলেই না তারা জানবে যে তাদের ওপর ধর্মের জন্য আক্রমণ করা হয়েছে, তাদের সহায়–সম্পত্তি গ্রাস করার জন্য নয়। ”
একটি ধর্ম গ্রন্থ যখন ধর্মের জন্য অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে লড়াই করার, প্রয়োজনে খুনাখুনি করার, আদেশ দেয়, এবং সে লড়াইয়ে প্রাণ হারালে মৃত্যুর পর পুরুষ্কার দেয়া হবে বলে প্রলুব্ধ করে সেই ধর্মগ্রন্ধ যারা অন্ধের মতো অনুসরণ করে তারা তো বিশ্বাসী হতে পারে না, তারা ভীতু! যে কোনো ভালো জিনিস মানুষে মানুষে রক্তপাতের অনুপ্রেরণা দিতে পারে না! একটি ধর্মেই যখন বলে দেয়া হয়, যারা সেই ধর্ম গ্রহণ না করবে তাদের শাস্তি পেতে হবে তাহলে সেই ধর্মের অনুসারীরা কিভাবে বিধর্মীদের ভালোবাসবে বা ভালো চোখে দেখবে? যাদেরকে ধর্মের নামে জবাই করলে বেহেস্তে অনেক পুরুষ্কার পাওয়া যাবে তাদের জন্য মনে কিভাবে ভালো চিন্তা জন্মাবে, তাদেরকে কিভাবে ভালোবাসা যাবে?
References
Bostom, A. G. (2010). The Legacy of Jihad: Islamic Holy War and the Fate of Non-Muslims. Prometheus Books.
Burhanuddin, S. (2010). Hidayah. Darul-Ishaat.
Roy, A., 2014. Biswasher-Virus. 1st ed. Dhaka: Jagriti Prokashoni.