ঘরে, বাইরে প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীরা বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার। দেশে মজুরীর ক্ষেত্রেও নারীরা চরম বৈষম্যের শিকার। চাকরি ক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তাও কম। বিশেষ করে বেসরকারি খাতে। আবার নিপীড়নের মাত্রা বেশি নারীদের। গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে শ্রমিক নিপীড়ন বেড়েছে। বিশেষ করে নারী শ্রমিকরা অপেক্ষাকৃত বেশি নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশের গার্মেন্টের বেশিরভাগ শ্রমিক নিয়োগ পত্র পায় না, যার ৮০% নারী। অপরদিকে, দেশে লাখ লাখ গৃহকর্মী রয়েছে। তারা মজুরীর দিকে দিয়ে চরমভাবে বঞ্চিত। এছাড়া, চরম অবহেলা ও নির্যাতন তো রয়েছেই।
হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের ১৭টি চা বাগানের নারী চা শ্রমিকরা দিনে পারিশ্রমিক হিসেবে পায় ১০২ টাকা। এ জন্য তাদের কাজ করতে হয় মোট ৮ ঘণ্টা। আর পুরুষ শ্রমিকরা কাজ করে ৩-৪ ঘণ্টা। অথচ উভয়ের ক্ষেত্রে পারিশ্রমিক সমান। দ্বিতীয়ত সেই টাকাও নারীরা নিজের হাতে পায় না। বাগান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নারী শ্রমিকদের পক্ষে তাদের স্বামী বা পরিবারের পুরুষ প্রতিনিধিই টাকা উত্তোলন করে। এথেকেই কতটা বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয় নারীদের প্রতি তা সহজেই অনুমেয়। উপরন্তু পুরুষ শ্রমিকরা পদোন্নতি পেয়ে সর্দার হলেও নারী শ্রমিকদের সাধারণত পদোন্নতি দেয়া হয় না। এছাড়া মাতৃত্বকালীন সময়েও বঞ্চনার স্বীকার হন নারী শ্রমিকরা আর এসব নিয়ে খবর প্রকাশিত হলেও তার কোন প্রতিকার হয় না। এই অবস্থা দেশের সব চা বাগান, কৃষি, নির্মাণসহ সব অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতেই বিদ্যমান। উপরন্তু দেশের বেসরকারি খাতের নারী শ্রমিকদের বেশিরভাগই মাতৃত্বকালীন ছুটি পায় না। অথচ সারাবিশ্বে এই নিয়ম চালু আছে। বরঞ্চ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে নারীর ন্যায় পুরুষরাও পিতৃত্বকালীন ছুটি পায়। অপরদিকে বাংলাদেশে সরকারি বিধান থাকা সত্তেও দেশের বেশিরভাগ কর্মস্থলে চাইল্ড কেয়ার হোম নেই। যা শিশু ও মায়ের স্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর।
আমাদের দেশের নারীদের বেশিরভাগই পৈত্রিক সম্পদ থেকেও বঞ্চিত। এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘দেশের ভূমিতে গ্রামীণ নারীর মালিকানা মাত্র ২.৪%।’ অন্যদিক, এ দেশের গৃহকতৃরা দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে সংসার পরিচালনা, সন্তান লালন-পালন ও শিক্ষার ব্যবস্থা করার পরও তারা কর্মের স্বীকৃতি পায় না। এমনকি তাদের এই উৎপাদনশীলতা জিডিপিতেও সংশ্লিষ্ট নয়। এ ব্যাপারে কতিপয় মন্ত্রী কয়েকবার আওয়াজ তুললেও পরবর্তীতে তার কোন সুরাহা হয়নি। অথচ এটা করা হলে দেশের জিডিপির পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পেত। সব মিলে দেশের জিডিপিতে নারীর অবদান প্রায় ৪০% আর এছাড়া সিপিডির গবেষণা রিপোর্ট মতে, নারীদের হিসাববহির্ভূত কাজ জিডিপির ৮৭ শতাংশের সমান। অথচ তার তেমন কোন স্বীকৃতি নেই।
একেতো এই দেশে নারীদের কাজের তেমন কোন স্বীকৃতি নেই তার উপর কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তার প্রচন্ড অভাব রয়েছে। তাই হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, নির্যাতন নিত্যদিনের ঘটনা এবং এগুলো ব্যাপক হারে ঘটছে। সারাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এক বছরেই ধর্ষণ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। প্রতিদিন গড়ে ১৪ জনের বেশি নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আর ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩ জনের বেশি নারী। গত ১০ বছরে নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে অর্ধ লক্ষাধিক। উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে নিম্নবিত্ত পরিবারের কারও কোন স্থানে নিরাপত্তা নেই। অথচ দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়েছে এমন নজির অনুপস্থিত।’ এমনকি এক রিটের প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ১৪ মে উচ্চ আদালত কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ১১টি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেন। তাতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে পৃথক আইন করার কথা বলা হয়। কিন্তু সেই আইন করা হয়নি এখনও!
এক গবেষণা রিপোর্ট মতে, ইন্টারনেটের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী নারীদের ৬৮% সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছে। অবশ্য নারী নির্যাতনের সব ঘটনাই মিডিয়ায় আসে না। তাই প্রকৃত ঘটনা আরও বেশি। নারী হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, নির্যাতনর ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির বিধান করে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা হলে এসব অপরাধ অনেক হ্রাস পাবে, তা নিশ্চিত। অপরদিকে, আমাদের দেশে বাল্য বিবাহের হার প্রায় ৬০%, যা বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক। দেশে তালাকের সংখ্যাও ব্যাপক। মূলত যৌতুক দিতে না পারার কারণেই এটা বেশি হয়। এছাড়া নানা নির্যাতনও হয়। অথচ এই প্রথাটি দেশে নিষিদ্ধ। কিন্তু তবুও এটা বহাল আছে। সংশ্লিষ্ট আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় এই অবস্থা চলছে এবং তা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের মধ্যে বেশি।