.

বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী যেকোনো ধরণেরঅপ্রাকৃতিক যৌনাচারএকটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ| ‘অপ্রাকৃতিকবলতে বোঝানো হয়েছে যেটা গতানুগতিক ধারার বাইরে| স্বাভাবিক বা গতানুগতিক বলতে যা আমরা বুঝে থাকি বা যুগ যুগ থেকে জেনে আসছি তা হলো নারী পুরুষের মধ্যে যৌন সম্পর্ক| এইস্বাভাবিকনিয়মের বাইরে যারা যৌন সম্পর্ক স্থাপন করবে তাদের জন্য বর্তায় ৩৭৭ ধারা| অর্থাৎ, যে বা যারা একই লিঙ্গের ব্যক্তি বা জীবজন্তুর সাথে যৌনাচারে লিপ্ত হবে তাদের কে শাস্তিস্বরূপ আজীবন কারাদণ্ড অথবা নুন্নতম ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হবে, ক্ষেত্রবিশেষে জরিমানাও ধার্য করা হতে পারে (Human Dignity Trust, 2022)|

.

এই আইন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে আরোপ করা হয়েছিল যা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা পরবর্তী আইন সংশোধনীতেও ধরে রাখা হয়েছে | বিভিন্ন বিবৃতি অনুযায়ী, এই আইন আসলে এখনো কারো ওপর প্রয়োগ করা হয়নি তবে সমকামী, উভকামী এবং রূপান্তরিত লিঙ্গের (Lesbian, Gay, Bi-sexual, Transgender – LGBT) ব্যক্তিবর্গকে অপদস্থ করার মূল হাতিয়ার হিসেবে ইহা ব্যবহৃত হয়ে থাকে | হিজড়া অথবা উভলিঙ্গকে ২০১৩ সালেতৃতীয় লিঙ্গহিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হয় |

.

সমকামিতা সাধারণ দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে যখন জুলহাশ মান্নান যিনি প্রথম বাংলা সমকামী ম্যাগাজিন রূপবানএর প্রতিষ্ঠাতা এবং তার একজন সক্রিয় কর্মী বন্ধুকে জুলহাশের বাসভবনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ২০১৬ সালের ২৪ শে এপ্রিল | স্থানীয় একটি ইসলামিক সংগঠন যাদের সাথে আলকায়েদার যোগসূত্র আছে, দাবী করে যে এই হত্যা তাদেরই কর্মকান্ড | এর ফলস্বরূপ LGBT সংগঠনের কিছু প্রথম সারির সক্রিয় কর্মীরা কেউ কেউ গা ঢাকা দেন আবার কেউ কেউ দেশত্যাগ করেন | ধারা ৩৭৭ কে লগ্নি করে ১৯ শে মে ২০১৭ তে, রেপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) কেরানীগঞ্জ-এর একটি কমিউনিটি সেন্টারে তল্লাশি চালিয়ে ২৭ জন পুরুষকে গ্রেফতার করে সমকামী আসরচালানোর দায়ে এবং ধারণা করা হয় ধারা ৩৭৭ এর অধীনে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে সমকামী হওয়ার ‘অপরাধে’ কিন্তু পরবর্তীতে যথাযোগ্য প্রমান এর অভাবে তাদেরকে মাদকদ্রব্য রাখার মামলায় আসামি করা হয় | মানবাধিকার আইনজীবীদের এবং মানবাধিকার কর্মীদের তাদের সাথে জেলে দেখা করতে দেয়া হয়না | সাধারণ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বদলে আধাসামরিক বাহিনী (র‌্যাব) দ্বারা এই ২৭ জনকে গ্রেফতার করার বিষয়টি নিতান্তই এই ইঙ্গিত দেয় যে বাংলাদেশী রাষ্ট্র সমকামিতা প্রতিরোধে এবং ধারা ৩৭৭ এর যথাযোগ্য বাস্তবায়নে কতটা তৎপর (Hossain, 2019)|

.

বাংলাদেশে কর্মরত এনজিও যারা সেসব পুরুষদের নিয়ে কাজ করে যারা পুরুষদের সাথেই দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে এধরণের এনজিও গুলোকে কৌশলগতভাবে হিজড়া গোষ্ঠীর তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে আইনি পরিচিতি পাওয়াকে জোর গলায় প্রচারণা করতে দেখা যায় তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্যর উদাহরণস্বরূপ অথচ ধারা ৩৭৭ নিয়ে তাদের নীরবতা স্পষ্টত লক্ষণীয় | অপরদিকে, উভলিঙ্গ বা হিজড়া গোষ্ঠী যাদের জন্য এই ধারাটি তেমন কোনো ভয়ের কারণ হতে পারে না, সেই তারাই এই ধারার বিরুদ্ধে সবথেকে বেশি প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে (Hossain, 2017)|

.

অভিজিৎ রায় (২০১০, পৃষ্ঠা ১২ ) তার বইতে লিখেছেন যে, ”১৯৭৩ সালের ১৫ই ডিসেম্বর American Psychiatric Association বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার মাধ্যমে একমত হন যে সমকামিতা কোনো নোংরা ব্যাপার নয়, নয় কোনো মানসিক ব্যাধি | হলো যৌনতার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি |” ধারা ৩৭৭ নিতান্তই মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকেঅস্বাভাবিকনামকরণ করে অনৈতিক এবং অমানবিকভাবে তাদের মানবিক অধিকার গ্রাস করার প্রক্রিয়া |

.

বাংলাদেশের বেশিরভাগ সমকামী বা উভকামীরা গা ঢাকা দিয়ে আছে, কারণ পরিবার, বন্ধুমহল, সমাজ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কোনোটাই তাদের জন্য নিরাপদ নয়  বেশির ভাগকেই মানসিক রোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে চিকিৎসা করানো হয়েছে  পরিবারের কাছে মানসিক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় পরিচিত জনদের কাছে থেকে তির্যক প্রশ্ন বা কথা শুনতে হয়  পরিবারের চাপে বিয়ে করে অনেক সমকামী মেয়েকে স্বামীর কাছে ধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে  এমনকি শুধুমাত্র মন খুলে দুটা কথা বলা যায় এমন সংস্পর্শের অভাবে অনেক সমকামীরা আত্মহত্যা করছে তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে  বাংলাদেশে সাধারণ জনগণই যেরূপ ঘৃণার চোখে দেখে সমকামী বা উভকামীদের তাতে করে এদের জন্য কোনো জায়গায়ই নিরাপদ নয় এই দেশে  এতটাই বিরূপ যে, যে কেউ যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় সমকামী বা উভকামীদের ওপর শারীরিক বা মানসিক আক্রমণ চালাতে পারে আর কেউ তা প্রতিবাদ করবে না  ধর্মের দোহাই টেনে এই সংখালঘুদের জনবহুল রাস্তায় কেউ খুন করলেও কেউ প্রতিবাদ করবে না, উল্টো বলবেআলহামদুলিল্লাহ

.

যে স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকেপশ্চিমা জীবনাচরণভেবে ধর্মীয় মৌলবাদীরা এর বিরুদ্ধাচরণ করে, সেই একই ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন বাংলাদেশী রাষ্ট্র পশ্চিমা একটি দেশ হতে প্রাপ্ত এই ধারা ৩৭৭ এর প্রয়োগ করে সেই স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে প্রতিরোধ করার জন্য | আশ্বাসের বিষয় হচ্ছে, ১৪৮ বছরের এই ঔপনিবেশিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে ২০০৯ সালে প্রতিবেশীদেশ ভারতের নয়াদিল্লির হাইকোর্ট সমকামিতা কোনো অপরাধ নয় বলে স্বীকৃতি দেয় (রায়, ২০১০ ) যা আমাদের মানবিক দৃষ্টি উন্মোচনে বেপক প্রভাব ফেলবে বলে আমি আশাবাদী।

    .

.

.

.

References

Hossain, A., 2017. The Paradox of Recognition: Hijra, Third Gender and Sexual Rights in Bangladesh. Culture, Health & Sexuality 1418, Volume 19(12).

রায়, ., ২০১০ . সমকামিতা. 1st ed. Dhaka: শুদ্ধস্বর.

.

Hossain, A., 2019. Section 377, Same-sex Sexualities and the Struggle for Sexual Rights in Bangladesh. Australian Journal of Asian Law, Volume 20, no-1, Article 9, pp. 1-11.

Human Dignity Trust, 2022. Bangladesh. [Online]
Available at:
https://www.humandignitytrust.org/country-profile/bangladesh/
[Accessed 6 June 2022].

.

.

.

.