বাংলাদেশি মোল্লাদের দুই চোখের দুশমন হচ্ছে রবি ঠাকুর। কারণ রবি ঠাকুর জানতেন বাঙালি হওয়ার মর্ম কী। মোল্লারা চায় না কেউ বাঙালি হিসাবে নিজেকে জানুক।
রবি ঠাকুরের ব্যাপারে বাংলাদেশি মোল্লাদের অভিযোগ হচ্ছে তিনি ব্রাহ্মন, হিন্দু। তিনি আনএপোলোজেটিক্যালি মুসলিম বিদ্বেষী, এবং বাংলাদেশ বিদ্বেষী।
সবচেয়ে জঘন্যতম প্রোপাগান্ডা হচ্ছে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। ফেসবুক এবং ব্লগে দেখা যায়-
“মূর্খের দেশে আবার কিসের বিশ্ববিদ্যালয়, তারাতো ঠিকমতো কথাই বলতে জানেনা”
যার দান করা ৬০০ একর জমির উপর আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল, বুয়েটের মতো দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড়িয়ে আছে। অথচ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে এইসব প্রতিষ্ঠানে কোন দোয়ার আয়োজন করা হয়নি। করা হয়নি কোনো স্মৃতিচারণামূলক অনুষ্ঠান। অন্যদিকে তৎকালীন সময়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাঙালি বিদ্বেষ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধীতার কথা কমবেশি সবারই জানা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় শুধু কঠোরভাবে বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হননি বরং তিনি ব্রিটিশদের সাথে রীতিমতো দেন-দরবার করেছিলেন যাতে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় না করা হয়। সেসময় রবীন্দ্রনাথ এক অনুষ্ঠানে দাম্ভিকতার সাথে বলেছিলেন “মূর্খের দেশে আবার কিসের বিশ্ববিদ্যালয়, তারাতো ঠিকমতো কথাই বলতে জানেনা!” অন্যত্র এক অনুষ্ঠানে এদেশের মানুষকে তীব্রভাবে কটাক্ষ করে রবী ঠাকুর বলেছিলেন “সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালী করে মানুষ করোনি”। অথচ সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন, মৃত্যুদিন, সাহিত্য উৎসবসহ আরো অনেক আয়োজন ধুমধামের সাথে পালন করা হয়।
আর যে বঙ্গসন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপকার সেই নবাব স্যার সলিমুল্লাহকে আজকের শিক্ষার্থীদের অনেকেই চেনাতো দূরের কথা নামটাও জানেনা। আমরা এতোটা অকৃতজ্ঞ যে বলতেও লজ্জা লাগে!
অথচ রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞরা বলেন এই ব্যাপারগুলোর কোনো ভিত্তি নাই। এই গুজবের সুত্রপাত ঠিক কবে হয়েছিল তা জানা খুব কঠিন, তবে বই হিসেবে গুজবটি প্রথম বাজারে ছাড়ে ২০০০ সালে মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন, বীরপ্রতীক, পিএসসি (সাবেক উপদেষ্টা, তত্বাবধায়ক সরকার) আহমদ পাবলিশিং হাউস থেকে প্রকাশিত ‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা’ নামে একটি বইয়ে এই তথ্য জানান যে, ”১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলিকাতা গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়।”
তবে সত্য কথা হচ্ছে ১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোলকাতায়ই উপস্থিত ছিলেন না; তিনি ছিলেন শিলাইদহে। ১৯ মার্চ ১৯১২ (৬ চৈত্র, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ) ভোরে কলকাতা থেকে সিটি অব প্যারিস জাহাজে রবীন্দ্রনাথের ইংল্যাণ্ড যাত্রার জন্য কেবিন ভাড়া করা হয়েছিল। তাঁর মালপত্রও জাহাজে উঠেছিল। সেদিন সকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে তাঁর ইংল্যান্ড যাত্রা স্থগিত হয়ে যায়।
তিনি ২১ মার্চ ১৯১২ তারিখে ডাঃ দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রকে লেখেন- ‘আমার কপাল মন্দ নইলে ঠিক জাহাজে ওঠবার মুহুর্তেই মাথা ঘুরে পড়লুম কেন? রোগের প্রথম ধাক্কাটা তো একরকম কেটে গেছে। এখন ডাক্তারের উৎপাতে প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। লেখাপড়া নড়াচড়া প্রভৃতি সজীব প্রাণীমাত্রেরই অধিকার আছে, আমার পক্ষে তা একেবারে নিষিদ্ধ।“
দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু বলার কোনো যৌক্তিকতা নাই। কারণ তিনি হিন্দু ছিলেনই না। তিনি ছিলেন একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম। রবীন্দ্রনাথের পিতা দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের সহচর। সে সময়ে কোনো উচ্চবর্গের হিন্দু সমুদ্র পার করায় নিষেধাজ্ঞা ছিল, যদি কেউ তা করে তবে তার জাত চলে যাবে! রাম মোহন এই নিষিদ্ধ যাত্রা করেন, আর ইংল্যান্ডে গুরুত্বপূর্ণ লোকেদের সাথে সাক্ষাত করেন, কিন্তু তিনি ১৮৮৩ সালে ব্রিস্টলে মারা যান, আর তাঁকে সেখানেই সমাহিত করা হয়।
দ্বারকানাথও এই নিষিদ্ধ যাত্রার ব্যাপারে মনস্থির করেন। তিনি ব্রাহ্মসমাজভুক্ত তিনজন তরুণ বাঙালীকে নিয়ে যান ব্রিটিশ মেডিকেল স্কুলে পড়াতে (তারাই প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইউরোপের মেডিকেল শিক্ষা নিয়েছিলেন)। ব্রিটেনে তাঁকে সম্ভাষণ জানাতে রাণী ভিক্টোরিয়া আর ব্রিটেনের হর্তা-কর্তারা আসেন। তাঁর প্রত্যাবর্তনও ছিল রাজসিক, এবং দ্বিতীয়বার তিনি তাঁর ভাতিজা এবং ছোট ছেলেকে নিয়ে ব্রিটেনে যান। তারা সেখানে দুই বছর অবস্থান করেন, কিন্তু দ্বারকানাথ অসুস্থ হয়ে পড়েন, এবং লন্ডনে আগস্ট ১৮৪৬ সালে, মাত্র ৫১ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
১৮৪৩ সালে দেবেন্দ্রনাথ (রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই) রাম মোহনের ব্রাহ্ম সমাজের পূনঃর্প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ব্রাহ্ম সমাজ একেশ্বরবাদীতায় বিশ্বাসী ছিলো। ব্রাহ্মরা ছিলেন উচ্চ মধ্যবিত্ত বাঙালী। যদিও তাঁরা বর্ণপ্রথার ঘোর বিরোধী ছিলেন, এবং প্রতিমা পূজাকে নাকচ করে দিয়েছিলেন।
বলা হয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথ বাঙালি বিদ্বেষী ছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে ভারতের ডানপন্থীরা উল্টো দাবি করে রবীন্দ্রনাথ বাঙালি ছিলেন, ভারতীয় না। আসলে রবীন্দ্রের রাজনীতি কী ছিল, তা জানা যায় যখন তিনি খ্যাতিমান অতিথি হিসেবে নিঊ ইয়র্কের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে যান, সেখানকার ‘অতিথি বই’তে তিনি নিজের জাতীয়তা হিসেবে “ভারতীয়” পরিচয় না লিখে, লেখেন “বাঙালী”।
বাংলাদেশি মোল্লাদের এসব তথ্য হয়ত জানা নাই। বা জানা থাকলেও তারা এসব এড়িয়ে যান যেন রবীন্দ্রের আড়ালে বাঙালি হিন্দু এবং সর্বোপরি বাঙালিদেরকে শত্রু হিসাবে এবং পাকিস্তান এবং আরবকে বন্ধু হিসাবে দেখানো যায়।