ঘরে এবং বাইরে নারীরা এখন যেন কোথাও নিরাপদ নয়৷ নারীরা পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে এমনকি কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পথেও অহরহ নির্যাতিত হচ্ছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, গত ১৩ মাসে বাস চালক-হেলপার ও তাদের সহযোগীরা ৯টি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ৮টি ধর্ষণ ও ৪টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটিয়েছে৷ এসব ঘটনায় ৫৫ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে৷ এই হল যাত্রাপথে নারীর হয়রানির চিত্র।
কর্মজীবী নারীরা কর্মস্থলে পুরুষ আধিপত্যের কারণেও মানসিক চাপে থাকেন। পুরুষ আধিক্যে কাজ করতে গেলে নারীদের লিঙ্গবৈষম্য, সমসুুযোগের অভাব, যৌন হয়রানি, কাজের চাপ ইত্যাদি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির গবেষকরা জানান, পুরুষ শাসিত কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে গেলে নারীদের মানসিক চাপের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা বিভিন্ন অসুখের জন্ম দেয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে তাদের অবমূল্যায়ন করা হয়। অনেক স্থানে তাদের ‘মাতৃত্বজনিত ঝুঁকি’ কিংবা ‘বেবি ব্রেন’ বলে অভিহিত করা হয়।
নারীরা কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন। কোনো মিটিংয়ে বড় পদের নারীকেও দাপ্তরিক কাজের সেক্রেটারি হিসেবে ভুল করা হয়। এক্ষেত্রে অনেকেই তার কাছ থেকে খাবার ও পানীয় নেওয়ার আশা করেন কিংবা মিটিংয়ের নোট রাখার মতো কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত বলে মনে করেন। আবার এমনও দেখা যায়, ডিপার্টমেন্টের প্রধান হওয়া সত্ত্বেও কোনো মিটিংয়ে গেলে ডিপার্টমেন্টের কোন পুরুষকর্মী প্রথমে অভিনন্দন পায় কোনো সফল কাজের জন্য। এভাবেই নারীর কাজের অবমূল্যায়ন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। নারীকর্মী মানেই পাক্কা চা সরবরাহকারী বলেও অনেকের ধারণা থাকে। তারা আবার আগ বাড়িয়ে দুই চামচ চিনিসহ এক কাপ চা/কফি চেয়ে বসে। নারী হয়ে যে উচ্চপদস্থ কর্মকতাও হওয়া যায় এটা যেন মানুষের মাথায়ই আসে না। আইনি সহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে আইনজীবীর প্রয়োজনে অনেকেই যোগাযোগ করে। এ সময় তাদের নারী উকিল দেওয়া হলে অপর পক্ষ থেকে মন্তব্য আসে কোনো পুরুষ নেই? অফিসে কাজের ক্ষেত্রে একই আইডিয়া একজন নারী দিয়ে থাকলে তা গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও পুরুষ সহকর্মীর সেই একই আইডিয়া ঠিকই গ্রহণযোগ্যতা পায়। অনেকেই আবার নারী সহকর্মীদের সন্তান সম্বন্ধে প্রশ্ন করেন। তাদের দেখাশোনার বা আর্থিক বিষয় নিয়েও অনেকে প্রশ্ন করেন।
‘মাতৃত্বজনিত ঝুঁকি’ হিসেবে বিবেচনা করে অনেক প্রতিষ্ঠানই নারীদের গর্ভবতী হওয়ার সময়টিকে হিসাব করে কর্মী নিয়োগ করতে চায়। তারা এ বিষয়টিকে তাদের জন্য ঝুঁকি হিসেবেই দেখে। কারণ গর্ভবতী হলে সে নারীকে ছুটি দিতে হবে। আবার মাতৃত্বজনিত ছুটি শেষে কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসার পর অনেক নারীকেই আর আগের মতো কর্মস্পৃহ বলে বিবেচনা করা হয় না বরং ‘বেবি ব্রেন’ বলে অভিহিত করা হয়।
তার অবস্থানও নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়।
কর্মস্থলে বহু নারীই যৌন নির্যাতনের শিকার হন।  বসের অনৈতিক প্রস্তাবে সাড়া না দিলে প্রমোশন হয় না। উল্টো বসকে সহযোগিতা না করার কারণ দেখিয়ে চাকরিচ্যুত করা হয়। এইতো গেলো কর্পোরেট অফিস কালচারের কথা। এছাড়া বাংলাদেশে রপ্তানি আয়ের ৮০ ভাগেরও বেশি আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে৷ আর এই খাত মূলত টিকে আছে নারী কর্মীদের ওপরই৷ এখানেও নারীদের হয়রানি এবং যৌন হয়রানির অভিযোগ পাওয়া যায় নিয়মিত৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই।
‘এস্টেট অব রাইটস ইমপ্লিমেন্টেশন অব ওম্যান রেডিমেড গার্মেন্টস ওয়াকার্স’ শিরোনামে এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিকদের শতকরা প্রায় ১৩ ভাগ যৌন হয়রানির শিকার৷ শারীরিক নির্যাতনের শিকার ২০ ভাগ নারী৷ নারী শ্রমিকদের ৮৪ দশমিক ৭ ভাগ মৌখিক হয়রানির শিকার হন৷ ৭১ দশমিক ৩ ভাগ শিকার হন মানসিক নির্যাতনের৷ আর এই নির্যাতনের কাজে শীর্ষে রয়েছেন সুপারভাইজাররা।
কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ নেয়ার জন্য সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকলেও  তা কার্যকর হচ্ছে না৷ নারী অভিযোগ করতে গিয়ে উল্টো হয়রানির মুখে পড়ছে৷ আইন আছে৷ কিন্তু তার বাস্তবায়ন নেই। যারা বাস্তবায়ন করেন অনেক সময় তাদের মধ্যেও সমস্যা থাকে। তাই বিচার চাইতে গেলেও হয়রানির শিকার হতে হয়ে নারীদেরকে।