লিখেছেন তন্ময় সরকার
ইতিহাস চিহ্নিত ‘মহান সম্রাট আকবর’ (আকবর দ্য গ্রেট) নেই, কিন্তু রয়ে গেছে বাংলায় তার রাজস্ব আদায়ের প্রয়োজনে তৈরি বঙ্গাব্দ তথা বাংলাবর্ষ। তার সুবে বাংলা বা নবাবী বাংলা ইংরেজদের রাজনৈতিক টানে খণ্ডিত হয়ে যে ছোটখাটো বঙ্গদেশের জন্ম তাও তাদেরই কূটবুদ্ধিতে বিভাজিত হয়ে এবং পাকিস্তানি বন্ধন ছিঁড়ে যে ক্ষুদ্র বাংলাদেশের আবির্ভাব; সেখানে আর যাই হোক, বাংলা তথা বৈশাখী নববর্ষের উদযাপন নিয়ে আবেগের কোন কমতি নেই।অন্তত রাজধানী নাগরিক পরিবেশে বৈশাখী নববর্ষের উদযাপনে বিশাল আয়োজনের ঘনঘটা দেখলে তেমনটাই মনে হবে।
পহেলা বৈশাখীতে নববর্ষ পালন আমাদের চোখে ঐতিহ্যবাহী বাঙালিয়ানার প্রকাশ।সে অর্থে জাতীয় সংস্কৃতির প্রকাশ। প্রকাশ যেমন সাংস্কৃতিক বিনোদনে, তেমনি বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক দিক বিচারে নববর্ষের হালখাতার চিরাচরিত অনুষ্ঠানে। যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতার নান্দনিক সম্পর্কের উদ্ভাস ঘটে। এ সম্পর্ক মূলত গ্রামবাংলার ঐতিহ্য, পরবর্তীকালের ছোটখাটো শহর পেরিয়ে কয়েক-দশক ধরে রাজধানীতে বর্ণবিভায় প্রতিষ্ঠিত। যে বর্ণ ছড়ায় আশার নব দ্যুতি, যোগায় আরও রঙ বাংলাদেশের সতের কোটি মানুষের ভিড়ে রংধনুর রঙের বৈচিত্র্যের মত জন্মানো, প্রতিটি ক্ষুদ্র বৈচিত্র্যময় লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষদের জীবনেও। বাংলার গ্রামীণ প্রকৃতির নব রূপ,রঙ যেন সেই দিনটায় প্রকটিত হতে চায়, তাদের জীবনবোধ থেকে;সাজগোজ আর পোশাকআশাকের বর্ণিল আয়োজন থেকে।
প্রতিবছর বাংলা নববর্ষের পহেলা বৈশাখীর দিনটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ হতে “মঙ্গল শোভাযাত্রার” পর্বটি শুরু হয়। এই পদযাত্রায় বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি-বোধে সচেতন প্রতিটি ব্যক্তি, তাদের নিজ নিজ অবস্থান হতে সেদিন অংশগ্রহণের চেষ্টা করে থাকেন।পাশাপাশি ভিনদেশী হাজারো নাগরিকের পদযাত্রা, এই শোভাযাত্রাটিকে দেয় এক আন্তঃ জাতীয় মেলবন্ধনের অপার সুযোগ।যাদের অনেকেই এই দিনটিতে একটু বাঙালী হবার চেষ্টায় বাঙালী সংস্কৃতি, বাঙালী পোশাকে নিজেকে সাজানোর চেষ্টা করে থাকেন।মঙ্গল পদযাত্রাটিতে বাঙালী সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানান প্রতীকী উপকরণ যেমন মুখোশ, বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি যেন শোভাযাত্রাটিকে দেয় এক ভিন্ন মাত্রা, করে আরও বর্ণিল।
সাধারণ মানুষের পাশাপাশি হিজরা,ট্রান্স জেন্ডার বা ক্যুইয়ার পরিচয়ের মানুষগুলোও নিজ নিজ অবস্থান থেকে এই পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। সমকামী নারী-পুরুষদের সেভাবে চিহ্নিত করা না গেলেও;হিজরা, ট্রান্স-জেন্ডারদের অংশগ্রহণ থাকে চোখে পরার মত।তাদের অনেকেই সেদিন পাঞ্জাবী পরেন, আবার অনেককেই পাওয়া যাবে যারা বাঙালী ধাঁচে শাড়ী,নাকে নথ বা নোলক পরেন।মাথায় কিংবা কানের একপাশে রঙিন ফুল গুজে দেন।কেউ বা আবার পায়ে আলতা মাখেন,কপালে টিপ দেন।এটিই তো একজন বাঙালী নারীর চিরাচরিত সাজ;যা ফুটে ওঠে এক একজন হিজরা,ট্রান্স-জেন্ডার বা ক্যুইয়ার নারীর অবয়বে।
বিভিন্ন ক্যুইয়ার সংগঠনও, তাদের সদস্যদের নিয়ে এই মঙ্গল পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করে থাকেন।যারা দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনায় অন্য সবার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন।এছাড়াও বিভিন্ন ক্যুইয়ার সংগঠন চেষ্টা করেন, প্রতি নববর্ষে কিছু আলাদা থিম নিয়ে কাজ করার।এ বিষয়ে ১৪২১ বঙ্গাব্দে নববর্ষের দিনটিতে “রূপবান” ক্যুইয়ার সংগঠনটির অংশগ্রহণ সর্বদাই উল্লেখযোগ্য। সেই নববর্ষের দিনটিতে তারা চেয়েছিলেন রংধনুর ছয় রঙে তাদের রাঙাতে। যেমন ছিলো চিন্তা,তেমনি হল কাজ। ছয় সারিতে,ছয়টি ভিন্ন রঙের পোশাকের সাজে একটি মিছিল সেদিন রূপবানের নেতৃত্বে, মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ গ্রহণ করেছিল। এক অদম্য আশা সাথে অন্য সবার মাঝে নিজেকে আপন পরিচয়ে তুলে ধারবার এক অপার আনন্দ সেদিনটিতে প্রকাশ পেয়েছিলো, মিছিলে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি ক্যুইয়ার পরিচয়ের মানুষগুলোর উচ্ছলতায়।
আজ দীর্ঘ সাতটি বছর পর,১৪২৮ নববর্ষের এই ব্রাহ্ম মুহূর্তে এসেও, এদেশের প্রতিটি বৈচিত্র্যময় লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষদের সেদিনের রূপবানের মিছিলটির মত আরেকটি মিছিলে অংশগ্রহণের কেবল ইচ্ছাই পোষণ করতে হচ্ছে । স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেও ক্যুইয়ার পরিচয়ের মানুষ গুলোর চাওয়া-পাওয়া কিংবা নিরাপদ লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের অধিকার নিয়ে এদেশে কেউ ভাবছেন বলে মনে হচ্ছে না।ধর্মীয় গোঁড়ামি সাথে সাম্প্রদায়িকতার যাঁতাকলে দিনের পর দিন পিষ্ট হতে হচ্ছে ক্যুইয়ার গোষ্ঠীর মানুষগুলোর লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের অধিকার। তাই যে আবেগের হাত ধরে বর্ষ শুরুর আবাহন, প্রীতির সুরে ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ বলে দিনটিকে বরণ করি, তা নিতান্তই একদিনের জন্যই। কারণ নববর্ষ উদযাপনে আমাদের আন্তরিকতায় যতটা না অসাম্প্রদায়িকতার গীতি গীত হয়, এর বিশাল আয়োজনে কিংবা এর বর্ণাঢ্য নান্দনিকতার মধ্যে মস্ত বড় একটি স্ব-বিরোধিতা রয়েছে;যেটি আমাদের জাতীয় চেতনাকে ঘিরেই। সুতরাং “নববর্ষ ১৪২৮ ” বঙ্গাব্দের, এই সূচনা লগ্নে দাঁড়িয়ে এক বুক আশায় এই বলে প্রার্থনা করছি-
“মঙ্গল দীপ জ্বেলে,
অন্ধকারে দু’চোখ আলোয় ধরো, প্রভু।”