সমকামিতার ব্যাপারে কোন ধর্মই উদার নয়, কিন্তু সকল ধর্মের ইতিহাস খুঁজে দেখলে আপনি দেখতে পাবেন সমকামিতা মুক্ত কোন ধর্মই নাই। তাহলে এই দ্বিচারিতার কারণ কী? সমকামিতা বিদ্বেষের পেছনে কী ধর্মই একমাত্র কারণ? না কি অন্য কিছু আছে? আমি এ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবি, ভেবে কূল পাই না। ধর্ম একটা ব্যাপক বিস্তৃত বিষয়, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম আরো বেশি, আর ইসলামিজম বা হিন্দুত্ববাদের মত রাজনৈতিক ধর্ম তো আরো বেশি জটিল ব্যাপার। তবে আমার মনে হয় সমকামিতা বিদ্বেষ কোন না কোনভাবে মানব আচরণের সাথে, পুরুষতন্ত্র; বিশেষত নারীবিদ্বেষের সাথে জড়িত।
খ্রিস্টান ধর্মে সমকামিতাঃ খ্রিষ্টান ধর্মে সমকামিতা নিষিদ্ধ, ওল্ড টেস্টামেন্টের লেভিটিকাসে এ ব্যাপারে সরাসরি বলা আছে যে যদি কোন পুরুষ অন্য পুরুষের সাথে নারীদের সাথে যেভাবে শোয় সেভাবে শোয় তাহলে তারা ঘোরতর অপরাধী। লেবীয় পুস্তকের অধ্যায় ২০- পরিষ্কারভাবে বলে সমকামে লিপ্ত ব্যক্তিদের হত্যা করতে হবে এমনভাবে যেন একের রক্তে অন্য ভিজে যায়।
তবে নিউ টেস্টামেন্টের ভাষ্য আলাদা। অনেক ধর্মবেত্তারা মনে করেন রোমানসের ১:২৬-২৭ সমকামিতাকে অপরাধ বলে গণ্য করে, আবার অন্যরা মনে করেন এখানে বিষমকামীদের সমকামিতা চর্চার ব্যাপারটাকে বিষোদগার করা হয়েছে। অর্থাৎ “প্রাকৃতিকভাবে” যারা সমকামি তারা সমকাম চর্চা করলে হয়ত সমস্যা নাই, কিন্তু যারা বিষমকামী হয়ে সমকামের চর্চা করেন তারা অপরাধী! অনেকে মনে করেন এর পেছনে কারণ হচ্ছে যারা নিউ টেস্টামেন্ট লিখেছেন তারা হয়ত জানতেন না যে সমকামিতা একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার।
খ্রিষ্ট ধর্ম যে রিফর্মের মধ্য দিয়ে গেছে সেটা আসলেই অনেক আশাজাগানিয়া একটা ব্যাপার। কমেডিয়ান লুইস ব্ল্যাক ওল্ড টেস্টামেন্ট আর নিউ টেস্টামেন্টের গডের তুলনা করতে গিয়ে বলেন- “ওল্ড টেস্টামেন্টের গড আর নিউ টেস্টামেন্টের গড একই সত্ত্বা, কিন্তু তাদের আচরণ অনেক আলাদা! হয়ত ছেলের বাপ হওয়ায় গডের রাগ কিছুটা কমেছে!”
ওয়েস্টবোরো ব্যাপ্টিস্ট চার্চ এখন সমকামিতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠোর প্রতিবাদ করে। তারা মানুষকে আহ্বান করে যেন তারা সমকামিদের সেসব সেবা না দেয় যা তারা অন্য নাগরিকদের দিত। যেমন সমকামিদের বিয়েতে কোন সেবা না দেয়, কেক না বানানো, ছবি না তোলা ইত্যাদি। তারা প্রায়ই সমকামিদের প্রাইড র্যালিতে গিয়ে প্রতিবাদ জানায়। এ পর্যন্তই। তারা কাউকে খুন করার দাবি জানায় না, রাষ্ট্রকে বলে না সমকামিদের হত্যা করতে যদিও ওল্ড টেস্টামেন্টে এই শাস্তির কথাই বলা আছে। ওদের এই কাজও ভুল, অবশ্যই, কিন্তু তারা সহিংসতার দিকে যায় না, তারা ডিসক্রিমিনেশন করে। আর তারা সংখ্যায় অনেক কম।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খ্রিষ্টান সেক্ট হচ্ছে রোমান ক্যাথলিকরা। তারা সমসাময়িককালে সমকামিতা নিয়ে কোন প্রকার বিবৃতি দেয় না। তারা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে প্রাধান্য দেয় বেশি। অনেকে বলেন রোমান ক্যাথলিক চার্চের এই অবস্থান হয়ত ওদের যাজকদের মধ্যে থাকা সমকামিদের জন্যই নেওয়া। যাজক-নানদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হাজার-হাজার শিশুর কেইস সামনে এসেছে বিগত কয়েক দশকে। গত তিন পোপ বারবার এ ব্যাপারের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন, আর সুষ্ঠু বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তবে এখানে একটা সমস্যা আছে। যৌন নিপীড়ন আর সমকামিতা এক না। সমকামিতা বিষয়ক আলোচনায় সমলৈঙ্গিক যৌন নিপীড়ন কখনোই আলোচিত হওয়া উচিত না। কারণ যৌন নিপীড়িন একটা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। সেটা সমকামিই করুক আর বিষমকামীই করুক। সমকামিতার আলোচনায় এই বিষয়টি নিয়ে আসা হয়, আমার মনে হয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই যেন দেখানো যায় যে সমকামিদের কিছু অংশ যৌননিপীড়ন করে। যৌননিপীড়নের আলোচনা একটা প্রয়োজনীয় আলোচনা, আর সেটা হওয়া উচিত, তবে সমকামিতার কন্টেক্সটে না।
ক্যাথলিক চার্চের কথা আলোচনায় নিয়ে আসলাম, এর পেছনে একটা কারণ আছে। কারণটা হচ্ছে যদি গোঁড়া খ্রিষ্টান যাজকরা সমকামিতার বিরোধিতাই করতেন অভিযুক্ত যাজকদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতেন। তবে সেটা অনেক কম ক্ষেত্রেই হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলোকে cover-up করা হয়েছে। এখানে একটা ক্ষমতার খেলা আছে অবশ্যই। ক্যাথলিক চার্চ নিজেদের নৈতিকতার জগতে উচ্চ স্থানে রাখার চেষ্টা করে, কারণ তারা যদি সেখানে না থাকে তাহলে কোটি কোটি খ্রিষ্টানদের জীবনের উপর তাদের যে নিয়ন্ত্রন সেটা কমে যাবে। নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার অধিকার, জন্ম নিয়ন্ত্রনের অধিকার ইত্যাদি ব্যাপারে বিশ্বের অনেক দেশে ক্যাথলিক চার্চ হস্তক্ষেপ করে। তারা যদি নৈতিক উচ্চাবস্থান থেকে নেমে যায় তাহলে তাদের এই ক্ষমতাও কমে যাবে।
অর্থাৎ তারা একই সময়ে পারছেও না স্বীকার করতে যে সমকামিতা তাদের যাজকদের মধ্যে একটা প্রচলিত চর্চা, আবার লুকিয়েও রাখতে পারছে না। তারা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করছে এসব কেইস কাভার-আপ করতে। অথচ কত সহজ হত স্বীকার করে নিলে যে সমকামিতা একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার আর তাদের যাজকদের অনেকে সমকামী! এর চেয়েও সহজ হত যদি তারা সবাইকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য দিয়ে দিত, শুধু ইউরোপীয়দের না, আফ্রিকান, ল্যাটিন, এশীয় সবাইকে!