দিন দিন যেন মানুষের বিবেক বুদ্ধি ক্রমশ লোপ পাচ্ছে। বাংলাদেশে গৃহকর্মী নির্যাতনের ভয়াবহতা হার বেড়েই চলেছে। মানুষ, মনুষ্যত্ব এবং মানবতার অপমানের অপর নাম গৃহকর্মী নির্যাতন। গৃহকর্মী নির্যাতনের অল্প কিছু ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় আর অধিকাংশ ঘটনাই থাকে পর্দার আড়ালে। যদিও শিশু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং এনজিও গৃহকর্মী নির্যাতনের বিষয়ে গবেষণা করে থাকে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১৭ বছরে (২০০১ থেকে ২০১৭) কর্মক্ষেত্রে ৫১৮ গৃহকর্মী লাশ হয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। অনেক গৃহকর্মীরাই কর্মক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনসহ হতাহত হয়। শুধু ২০১৭ সালেই মারা গেছে ৫০ গৃহকর্মী। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতনে অনেক গৃহকর্মী মারা গেছে, অনেকে আহত হয়েছেন এমনকি হত্যাকান্ডেরও শিকার হয়েছে কেউ কেউ। এছাড়া যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে অগনিত এবং তাদের মধ্যে অত্যাচারে নিপীড়নে আত্মঘাতী হয়েছেন বেশকিছু সংখ্যক নারী-শিশু। গৃহকর্মীরা নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে।
গৃহকর্মীদের সাথে শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতন ও শোষণের পাশাপাশি পাচারের ঘটনাও ঘটে। বাসাবাড়িতে প্রতিনিয়ত চড়-থাপ্পর, লাথি-ঘুসি, পর্যাপ্ত খাবার খেতে এবং ঘুমোতে না দেওয়ার মতো শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে অহরহ। একই সাথে অকথ্য ভাষায় বকাঝকা, বিভিন্ন নামে ডাকা, বংশ পরিচয় নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, অবহেলা করা ইত্যাদি মানসিক নির্যাতন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এছাড়াও ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনাও ঘটছে, এমনকি নির্যাতনের ফলে হচ্ছে মৃত্যুও।
নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেকে আবার আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। কম বয়সী মেয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে নির্যাতনের ঘটনা বেশি হলেও, ছেলে শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের নির্যাতনের ঘটনাও উল্লেখযোগ্য। গৃহকর্মী নির্যাতনের কারণ অনুসন্ধান এখন সময়ের দাবি। বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিশু বা কিশোরদের অভারে তাড়নায় গৃহকর্মী রাখা হয়। নিয়োগকর্তা, কর্ত্রী, নিয়োগকর্তার পরিবারের কোনো সদস্য দ্বারা তারা হামেশাই নির্যাতনের শিকার হয়। তবে দুঃখজনক যখন সমাজের শিক্ষিত এবং সচেতন শ্রেণি গৃহকর্মী নির্যাতনের অপরাধে লিপ্ত হন। বলা চলে এটি মানুষের মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ।
কাজেই এখন সময় এসেছে মানবতা বিরোধী গর্হীত গৃহকর্মী নির্যাতন রুখতেই হবে। কেবল আইন করে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। আমাদের মন মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে এবং সেই সাথে গৃহকর্মীর সাথে মানবিক হতে হবে। গৃহকর্মীকে পরিবারের সদস্য হিসেবে দেখতে হবে। গৃহকর্মী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। গৃহকর্মী নির্যাতন বন্ধে অবিলম্বে গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালার বাস্তবায়ন করতে হবে। শুধু সরকার নয় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে গৃহকর্মী নির্যাতন প্রতিরোধে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। দূর হোক গৃহকর্মী নির্যাতন, মুক্তি পাক মানবতা- এমনটিই প্রত্যাশা।