আমরা আজ এমন এক অবস্থায় এসে দাড়িয়েছি যেখানে নারীরাই শুধু নন শিশুকন্যারাও ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। নারীদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত হয়রানির শিকার হলে প্রতিবাদ করেন তবে ঘরে কন্যাশিশুদের শেখানো হয় এমন পরিস্থিতির কথা কাউকে বলবে না। শুধু মেয়েশিশুই নয়, একই সঙ্গে ছেলেশিশুরাও যৌন হয়রানির শিকার হয়। তবে তা মেয়েশিশুদের তুলনায় কম। তবে এখনই সময় সব শিশুকেই অভিভাবকদের শেখাতে বা বোঝাতে হবে যে পরিবারের কেউ বা বাইরের কোন চেনা-অচেনা যেই হোক না কেন কথা বা কাজে কোনো অসংগত আচরণ করলেই যেন মা-বাবাকে তারা জানায়। অনেক মায়েরা আছেন, যারা সরল মনে পরিচিত-অপরিচিত পুরুষের কোলে মেয়েটিকে বসিয়ে দেন। এসব করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, কার বিকৃতি কখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, তা তারা নিজেরাও জানে না। কারও ছেলেসন্তান ও মেয়েসন্তান দুটোই থাকলে ছেলেকে মেয়েদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করতে শেখাতে হবে। যাতে যেকোনো মেয়ে তাদের সামনে আক্রান্ত হলে ছেলেরা রক্ষায় এগিয়ে আসতে পারে। অভিভাবকদের শিশুকে এভাবেও সচেতন করতে হবে, যে কেউ চকলেট, খেলনা বা কোনো উপহারের লোভ দেখিয়ে তাকে আড়ালে নিতে চায়, তাহলে তারা যেন কিছুতেই সেসব নিতে রাজি না হয় বা সেখান থেকে ছুটে পালিয়ে আসে। প্রয়োজনে চিৎকার করতে হবে। পারিবারিকভাবেই শিশুদের এই শিক্ষা দিতে হবে তারা বাবা-মায়ের সংগে যেন সবকিছু শেয়ার করে।
২০১৪ সালে ইউনিসেফের জরিপ অনুযায়ী সারা বিশ্বে ১০ জনে একজন মেয়েশিশু যৌন নির্যাতনের শিকার। বিষয়টিকে মোটেও হাল্কাভাবে নেওয়ার অবকাশ নেই। আপনার বাসায় কোন পুরুষ সদস্য আসলে সতর্ক থাকতে খেয়াল করতে হবে বাচ্চার আচরণে কোন পরির্বতন দেখা যায় কিনা বা বাচ্চা কোন ভাবে ভয় পাচ্ছে কিনা। একটুখানি অসচেতনতায় আপনার শিশুটি ট্রমাটাইজড হয়ে যেতে পারে। এই বিস্মৃতি তাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। এখনই সময় সচেতন হওয়ার। মুখ বুঝে সহ্য করা চলবে না কোনভাবেই। কাউকে অগাধ বিশ্বাস করে বাচ্চাকে একা ছাড়া পরিহার করতে হবে অবশ্যই। নিজের ফ্যামিলি মেম্বারের কাছেই এখন একটা বাচ্চা নিরাপদ না সেখানে কোন ভরসায় পরিচিত, অল্প পরিচিত, প্রতিবেশী কিংবা ড্রাইভার, মালিকে বিশ্বাস করবেন?
আমাদের সমাজে মেয়েদের শেখানো হয়, কলঙ্ক হয় মেয়েদের, ছেলেদের নয়। সুতরাং যৌন নির্যাতনের কথা বলে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা বোকামি। এসব জানলে পরবর্তী সময়ে প্রেম, বিয়ে, কর্মক্ষেত্র সবখানেই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। নির্যাতিত মেয়েটির মা-বাবা-ভাইবোন সমাজে হেয়প্রতিপন্ন হবে। কিন্তু তারা এটা ভুলে যায় যে তার যৌন নিপীড়নের কথা চেপে রাখতে রাখতে শিশুটি একদিন অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়তে পারে, আত্মহত্যার মত চরম ভুল পথে পা বাড়াতে কিংবা প্রতিশোধপরায়ণতায় নিজেই হত্যাকারী হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং শিশুদের কথা বলতে দিতে হবে, তাদের কথা শুনতে হবে, তাদের বিরূপ পরিস্থিতি সম্পর্কে সজাগ করতে হবে। আর যদি কেউ এর শিকার হয়েও পড়ে, তাকে বোঝাতে হবে যে এতে তার কোনো অন্যায় নেই, এটা তার অপরাধ নয়।
বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ আমাদের চারপাশেই ঘুরছে। এই ধরনের ঘৃণ্য অপরাধীদের কোন মতেই ছাড় দেওয়া চলবে না। তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে যাতে তাদের সম্মানহানি হয়। এটাকে প্রতিবাদ ও আইনের মাধ্যমে প্রতিকার করার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ‘মেয়েদের নিজেদের দোষে নিজেরা আক্রান্ত হয়’ এই মনোভাব পুরোপুরি ত্যাগ করে ত্বরিত সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করবে।
Awareness বা সচেতনতা কেবল ঘরে অবিভাবকেরাই নন স্কুল/কলেজে এগুলো শিখাতে হবে। তার আগে শিক্ষক নিয়োগেও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। প্রায়ই খবরে দেখা যায় শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীর শ্লীলতাহানি বিশেষ করে কোচিং ক্লাসে। ৫০ বছর আগে কোচিং সেন্টার ছিলনা। স্কুলের শিক্ষকেরা নীতিবান ছিলেন এবং লেখা পড়ায় ভাল ছাত্ররাই শিক্ষক হতেন। বালিকা বিদ্যালয়ে অবিবাহিত/অল্প বয়স্ক পুরুষ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হতোনা। এধরণের কিছু ব্যাপার আমাদের অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। কেননা সামাজিক অবক্ষয় ও মূল্যবোধ ক্রমেই লোপ পাচ্ছে এবং পরিবর্তন আনতে হলে সামাজিক বিপ্লব দরকার।