যেকোন ধর্ষন সংবাদ সামনে আসার পর নাগরিক হিসাবে আমাদের ঈমানি দায়িত্ব হয়ে দাড়ায় অভিযুক্ত ধর্ষকের কঠোরতম শাস্তির দাবি করা। কঠোরতম শাস্তি বলতে কারোর কাছে মৃত্যুদন্ড। কেউ একটু বাড়িয়ে ধর্ষকের পুরুষাঙ্গ কেটে নেওয়ার কথা বলে। অনেকে আর এক ডিগ্রি উপরে উঠে মতামত দিয়ে থাকে রেপিষ্টের মা বোনকে রেপ করা হোক, তবেই রেপিষ্ট বুঝবে জ্বালা। ধর্ষনের বিরুদ্ধে কঠোর ‘প্রতিবাদ’ করতে গিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই ধর্ষনের সংস্কৃতিকে সাপোর্ট করা। যারা ঘুরিয়ে পেচিয়ে এই ধরনের রেপের কথা যারা বলে তারাওতো পোটেন্সিয়াল রেপিষ্ট।
ধর্ষকের কঠোরতম শাস্তির দাবি করে নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতে চাই আমরা। কিন্ত আমরা ভুলে যাই কঠোর শাস্তি বা ডেথ পেনাল্টি চালু হলেই তার পরের দিন থেকে নৃশংস হত্যা বন্ধ হয়ে যাবে না। একেকটা ধর্ষনের ঘটনায় গোটা দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, মানববন্ধন হয়, ক্ষোভে ফেটে পরে মানুষ। আবার কঠোর শাস্তির দাবি ওঠে। সমস্যার শিকড় খুজে বের না করে কঠোর শাস্তিবিধানের ফোকাসে আটকে থাকে জনসাধারণ আর রাষ্ট্রের কাছে থাকে জোনরোষ নিভিয়ে দেওয়ার ছু-মন্তর।
কড়া শাস্তিতে সমাধান সুত্র খোঁজার আগে আমাদের ‘ধর্ষন’ সম্পর্কীয় ধারনার পরিবর্তন হওয়া দরকার। ‘ধর্ষন’ আদতে একটি ঘৃন্য শারীরিক আক্রমন। যিনি আক্রমন করেন তিনি আক্রমনকারী এবং যার উপর আক্রমন হয় তিনি আক্রান্ত। কিন্তু আমরা ‘ধর্ষন’, ‘ধর্ষক’, ‘ধর্ষিতা’ এই সব শব্দ ব্যবহার করে আক্রান্তের উপর সতীত্ব, সম্ভ্রম ও মর্যদার বোঝ চাপিয়ে দিই। যে কারনে আক্রান্ত মহিলা বাকি জীবনটা সেই ‘লজ্জা’ বয়ে বেড়ান। ঠিক সেই কারনেই ধর্ষিতাকে অহরহ শুনতে হয় এই বুঝি জীবনটাই শেষ হয়ে গেলো। একজন ‘ধর্ষিতা’ নারী যে শুধু একবারই ধর্ষনের শিকার হয় তা কিন্ত নয় বরং পাড়াপ্রতিবেশীর কথাবার্তায়, মিডিয়ায়, বুদ্ধিজীবির আলোচনায় সে বারবার ‘ধর্ষিতা’ হয়। সামাজিকভাবে আমাদের উচিৎ এই ধর্ষন সম্পর্কীয় ধারনার পরিবর্তন। আক্রান্ত নারী কেন লজ্জা নিয়ে বাচবে? লজ্জা তো তার না, লজ্জাটা সমাজের। লজ্জাটা দিতে হবে ধর্ষককে। ‘ধর্ষিতা’ শব্দটিই নারীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে, তাই এই ঘৃন্য শব্দের অবলুপ্তি দরকার। আক্রান্ত নারীর ছবি নয়, বরং আক্রমনকারীর ছবি সামনে আসুক।
‘ধর্ষন’ কখনও পাল্টা প্রতিশোধ, কখনও আবার রাজনৈতিক অস্ত্র। ধর্ষনের সঙ্গে মানসম্মানের প্রশ্ন সামাজিকভাবে জড়িয়ে দেওয়া হয় বলেই এই প্রবনতা গুলো দেখা যায়। যেকোন যুদ্ধ বিগ্রহে বা বীভৎস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার হাজার ‘ধর্ষনের’ ঘটনা ঘটে ঠিক এই কারনেই। এখানে ‘ধর্ষক’ যেন বিজয়ী, আর যাকে ‘ধর্ষন’ করা হল সে যেন পরাজিত আমরা অবচেতনভাবেই এই বদ্ধমূল ধারনা লালন করি। এযেনো এক পুঁজিবাদী ঘৃন্য মানসিকতা যা নারী শরীরকে পন্যায়িত করে নারীকে আরো বেশি করে ভোগ্যবস্তু ভাবার মানসিকতাকে পোক্ত করছে। আমাদের সমাজে “সতীত্ব” এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা “মর্যাদা” মানুষের জীবনের থেকেও বেশি মূল্য পায়। সতীত্বকে অতিমাত্রায় মূল্যায়িত করা হয় বলেই নারী নিরাপত্তাহীনতাই ভোগে।
আমাদের সমাজ নারীদের সাবধান করে থাকে বিভিন্নভাবে যাতে তারা ধর্ষনের স্বীকার না হয় কিন্তু এই সামাজে যাতে ধর্ষকের জন্ম না হয় সেদিকে ফোকাস নেই বললেই চলে।কন্যাসন্তান রাস্তায় বেরোলে সুরক্ষিত কি না সেটা যদি চিন্তার বিষয় হয়ে থাকে তাহলে এটাও চিন্তার বিষয় হওয়া উচিৎ পুত্রসন্তান ভবিষ্যতে ধর্ষকে পরিনত হবে না তো? কারন ধর্ষক ও তার ধর্ষন মানসিকতা এই সমাজেরই বাইপ্রোডাক্ট। একটি পরিবারে নারীদের প্রতি ধ্যানধারনা কেমন এসবই শিশুমনে দাগ কাটে। পুত্রসন্তান যদি দেখে কথায় কথায় তার বাড়ির পুরুষ অভিভাবকেরা তার মাকে ছোট করছে তাহলে সে নিজেকে শিখিয়ে নেবে যে নারীদের এভাবেই ছোট করতে হয়। ছেলেকে শেখান নারীকে নারী হিসেবে নয় একজন মানুষ হিসাবেই সম্মান দিতে।