পরিবারে মূল উপার্জনকারীরা পুরুষ হওয়াতে তাদের অসুখ-বিসুখে দ্রুত ডাক্তার দেখানো হয়। মেয়েদের অসুখের কথা পরিবার আমলে নেয় না, বিশেষ করে শ্বশুরবাড়িতে। তা ছাড়া কোনো নারীর মানসিক সমস্যা হলে পরিবারের সদস্যরা বদনামের ভয়ে তাকে ডাক্তারের কাছে নিতে চান না। নারীরাও নিজেদের রোগ সম্পর্কে সচেতন নন। তাদের মধ্যে রোগ হলে তা লুকানোর একটি প্রবণতা থাকে। অথচ সময় মতো মনোরোগের চিকিৎসা না করানোর ফলে অবস্থা আরও জটিল আকার ধারণ করে এবং ততদিনে এমন অবস্থায় পৌছায় যখন আর কিছুই করার থাকে না।
যদিও বলা হয় “সুস্থ দেহ প্রশান্ত মন, কর্মব্যস্ত সুখী জীবন।” বেচে থাকার মঙ্গলমন্ত্র এটাই। হওয়া উচিৎ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সকলে মানেন না এই মঙ্গলমন্ত্র। শরীরের সঠিক যত্নও ঠিকঠাক ভাবে নেয় না সবাই। খুব কম মানুষই আসলে নিজের শরীরের ব্যাপারে সচেতন থাকেন। রোগবালাই খুব চরম অবস্থায় না পৌছলে আমরা সহসা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই না। যেখানে আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্য নিয়েই কোন মাথাব্যথা নেই সেখানে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা অনেক পরের বিষয়। তাও আবার যদি হয় নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য। অথচ শরীরের পাশাপাশি মনেরও যত্ন নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
আমাদের সমাজে নারীরা শারীরিক অসুস্থতা, অপর্যাপ্ত ঘুম, সাংসারিক কাজ, যৌন নির্যাতন, ইভ টিজিং, পারিবারিক নির্যাতনসহ নানা ধরনের মানসিক চাপে থাকেন। আবার মেনোপজ, গর্ভকালীন বিষণ্নতা, বয়ঃসন্ধিক্ষণসহ কিছু প্রাকৃতিক নিয়মের কারণেও নারীরা বিষণ্নতা, হতাশা, কাজে অনীহাসহ নানা ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশে এটাকে অসুখ বলে গণ্য করার প্রবণতা এখনো তৈরি হয়নি।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (এনআইএমএইচ) সাধারণ মানসিক অসুস্থতাগুলোর লক্ষণ বুঝতে এ বছর দুটি এলাকায় এক জরিপ চালায়। এতে দেখা যায়, নারী-পুরুষনির্বিশেষে জরিপে অংশগ্রহণকারী লোকজনের ৩৩ শতাংশ বিষণ্নতা, উদ্বেগ, শুচিবাই, সিজোফ্রেনিয়া বা অন্য কোনো মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন। তবে নারীদের মধ্যে এই হার বেশি। তাদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ এমন অন্তত একটি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। পুরুষদের মধ্যে এমন সমস্যা রয়েছে ২৭ শতাংশের।
আসলে আমাদের সমাজে ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের শেখানো হয় তুমি মেয়ে। এটা তোমার করা উচিত, এটা করা উচিত নয়। এতে শৈশব থেকেই মেয়েশিশুরা মানসিক বিপর্যস্ততা নিয়ে বড় হতে থাকে। জীবনে প্রতিটি ধাপেই নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির ভাবা হয়। এতে নারীর ভেতর হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, যা নারীকে বিপথগামী করে তুলতে পারে। নারীর মানসিক সুস্থতার জন্য শৈশব থেকেই তাকে সুন্দর পরিবেশ দিতে হবে, এতে সে ছোটবেলা থেকেই মানসিকভাবে দৃঢ় হবে। নারীরা মন খুলে তার মানসিক অবস্থার বিষয়ে কথা বলতে পারে না। অথচ মন খুলে কথা বলতে পারলে আর কাউন্সেলিং নেওয়ার সুযোগ পেলে নারীদের অনেক মানসিক সমস্যাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। ’
নারীরা সাধারণত বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, হিস্টিরিয়া বা স্মরণশক্তি কমে যাওয়ার মতো সমস্যায় বেশি ভোগেন। প্রজননচক্রের প্রভাব তো আছেই। মেয়েদের থাইরয়েডগ্রন্থির সমস্যাও বেশি হয়, যা থেকে এ ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
অবহেলা ও লোকলজ্জার ভয়ে নারীরা মানসিক সমস্যায় ভুগলেও তারা তা বুঝতে দেয় না।নারীর জীবনে মেনোপজ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মেনোপজের সময়টায় নারীদের মাঝে বিরক্তির উদ্রেক, দুশ্চিন্তা, ভালো না লাগা, রেগে যাওয়া, খাবারে অনীহাসহ অসংখ্য মানসিক পরিবর্তন শুরু হয়। এ রকম মানসিক পরিবর্তন দেখা যায় বয়ঃসন্ধিক্ষণের সময়টাতেও। এ ছাড়া গর্ভধারণে অক্ষমতা, গর্ভপাত, ছেলেসন্তান না হওয়া নিয়ে উতকণ্ঠা, গর্ভবতী অবস্থায় হীনম্মন্যতাবোধ, বিষণ্নতা নারীর মানসিক চাপ অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়।
মানসিক রোগীর মেজাজ বা মুড পরিবর্তিত হতে থাকে। কখনো উত্তেজনা ও উন্মত্ততায় মন বিক্ষিপ্ত থাকে আবার কখনোবা অহেতুক দুঃখে মন অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এটা কয়েক ঘণ্টা বা মিনিটের ব্যবধানেও যেমন হতে পারে, তেমনি কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক মাসও চলতে পারে। এ ধরনের ভাব পরিবর্তন দৈনন্দিন জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের ফল বলে মনে হতে পারে। একারণে এটা যে মানসিক সমস্যা, তা নিকটজনও বুঝে উঠতে পারেন না।
আজকের যেই কন্যাশিশুটি আগামী দিনে উঠবে কোনো এক পরিবারের কর্ত্রী। সংসারের সবার দেখভালের দায়িত্ব তার কাধেই বর্তাবে। একারণেই কিশোরীটির বয়ঃসন্ধিতে যেমন তার মানসিক যত্নের প্রয়োজন, তেমনি একজন নারী যার কাধে অলরেডি রয়েছে সংসারের সকল সদস্যদের দেখভালের দায়িত্ব তারাও মুখোমুখি হচ্ছেন মানসিক সমস্যার। তাই তারও শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনের বিষয়টিও খেয়াল করা দরকার পরিবারের প্রতিটি সদস্যের।