জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে নিপীড়নের শিকার হওয়া নারীরা যৌননিপীড়নের ঘটনার কথা অনেক সময়ই লোকলজ্জার ভয়ে বলতে পারেন না। কিংবা সাহস করে যে বা যারা বলেও ফেলেন তারাও সেই অর্থে প্রতিকার তো দূরের কথা মরাল সাপোর্ট বা মানসিক সহযোগিতাও পান না কারো কাছ থেকেই। পরিবার থেকেই বলে দেওয়া হয় এমনকোন অবস্থার সৃষ্টি হলে আর তা জানাজানি হয়ে গেলে পরিবারের সম্মানহানি হবে এবং সেক্ষেত্রে বিচার পাওয়ার পরিবর্তে তারাই উল্টো সমাজে হেয়প্রতিপন্ন হবে। এসব ভেবেই সাধারণত নারীরা এধরনের হেনস্তার শিকার হয়েও সামাজিক দৃষ্টিকোনের বিচারে প্রায়শই চুপ থাকে।
অনেক সময় ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে গেলে কেউ কেউ প্রকাশ্যে কিংবা কৌশলে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। রাস্তাঘাটে কিংবা গণপরিবহনে অথবা যেখানে জনসমাগম বেশি হয় সেসব জায়গায় প্রায়শই নারীরা হেনস্তার শিকার হয়ে থাকে।আমাদের আশেপাশে অহরহ এধরনের ঘটনা ঘটছে। আমরা সব খবর হয়তো রাখতে পারিনা। যৌন হেনস্থার শিকার হওয়া কোন নারী যদি কৌশলে হেনস্থাকারীর ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেন অথবা সাহস নিয়ে ঘটনাস্থলেই প্রতিবাদ করেন সেক্ষেত্রেই কেবল এসব নিয়ে ব্যপক আলোচনার সৃষ্টি হয় বা অনেকের দৃষ্টিগোচর হয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চলা ফেরার সময় ঠিক কতজন যৌন হেনস্থার শিকার হন তার সঠিক সংখ্যা অনুমান করা মুশকিল। কিন্তু এ ধরণের হেনস্থার শিকার হলে নারীর আসলে কি করা উচিত তা তারা তৎক্ষনাৎ বুঝে উঠতে পারেন না। যারফলে অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার শিকার হলেও সেসব কথা জানাজানি হয়না। এরফলে পরবর্তিতে আরও অনেক নারীরা এধরণের পরিস্থিতিতে পরেন শুধুমাত্র একটু সচেতনতার অভাবে ।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক দ্বারা পরিচালিত ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা যায়, গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারীরাই কোনো না কোনো ভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আর হেনস্থাকারীদের অধিকাংশই দেখা গেছে মধ্যবয়সী বা বয়স্ক পুরুষ। উল্লেখিত, জরিপের তথ্য অনুযায়ী ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের দ্বারা এ ধরণের যৌন হয়রানি বেশি হচ্ছে।
আবার আরেক বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইডের জরিপ অনুযায়ী ৮৪ শতাংশ নারীরা জানিয়েছেন, তাঁরা জনসমাগমস্থলে অশালীন মন্তব্য শুনেছেন এবং সেখানে পুরুষেরা যৌন হয়রানি করার সুযোগ খুঁজেছিলেন। অর্ধেকের বেশি নারী গণ পরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। এছাড়াও কয়েক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় যে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ৭৬ শতাংশ ছাত্রীই কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হন। এর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ হার সবচেয়ে বেশি: ৮৭ শতাংশ। আর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোতে ৭৬ শতাংশ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৬ শতাংশ এবং মেডিকেল কলেজে যৌন হয়রানির শিকার হন ৫৪ শতাংশ ছাত্রী।
এখন প্রশ্ন হলো হেনস্থার শিকার নারীর করনীয় কি? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাস্তাঘাট কিংবা যানবাহনে হেনস্থা বা যৌন হয়রানির শিকার হলেও তাৎক্ষণিক ভাবে কেউ প্রতিবাদ করে না। প্রযুক্তির কল্যানে অনেকেই এখন বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করলেও সামাজিক ভাবে হেয়-প্রতিপন্ন হওয়া কিংবা অন্যান্য নানান ধরনের ঝক্কি-ঝামেলার কথা ভেবে পুলিশের কাছে অভিযোগ করে না। কেউ যদি এধরণের অভিযোগ করে থাকে তাহলে অবশ্যই পুলিশের উচিত অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে ঘটনাস্থলে কাউকে পাঠিয়ে তদন্ত করা। এক্ষেত্রে রাস্তায় বা আশেপাশের ভবনে থাকা সিসিটিভি ফুটেজগুলো সহায়ক হতে পারে।
লোক সমাগম আছে এমন স্থানে যদি কোন ধরনের হেনস্তার ঘটনা ঘটে তবে সংগে সংগে প্রতিবাদ করা উচিৎ। কোন আক্রান্ত নারী তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করতে পারেন তাহলে একদিকে দায়ী ব্যক্তি যেমন দ্বিতীয়বার এমন কাজ করার ক্ষেত্রে ভয় পাবে তেমনি এটি ঘটনাস্থলে প্রত্যক্ষদর্শী তৈরিতেও ভূমিকা রাখবে। আর যদি কোনো নির্জন স্থানে এমন ঘটনা ঘটে তাহলে একজন নারীকে অবশ্যই প্রথমে নিজের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে এবং সেক্ষেত্রে নিজের বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ ঘটাতে হবে সুকৌশলে। এক্ষেত্রে যদি দায়ী ব্যক্তির ছবি বা ভিডিও কোনভাবে সংগ্রহ করে রাখা যায় তাহলে পরবর্তিতে সেটিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য সহায়ক হবে। মূলকথা হলো, যেকোন ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য কন্যা সন্তানকে শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্ত করে গড়ে তোলার বিষয়ে পরিবারকে তথা সমগ্র সমাজকে সচেতন হতে হবে।
পুলিশ ও আইনজীবীরা নানা সময়ে যৌন হেনস্তার শিকার হওয়া নারীদের জন্য নানানরকম পরামর্শ দিয়েছেন। সেইসব পরামর্শ অনুযায়ী যেকোন জায়গায় হয়রানি বা হেনস্থার শিকার হলে নারীরা নিম্নোক্ত কাজগুলো করতে পারেন।
১. কোথাও অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পরলে চিৎকার দেয়া ও প্রতিবাদ করা।
২. সম্ভব হলে ঘটনাস্থলের লোকজনকে সম্পৃক্ত করা।
৩. যত দ্রুত পারা যায় নিকটস্থ থানায় যেতে হবে।
৪. যদি সম্ভব হয় তাহলে প্রত্যক্ষদর্শী কাউকে সাথে করে নিয়ে থানায় যাওয়া।
৫. সুযোগ থাকলে ছবি তুলে বা ভিডিও করে তা পুলিশকে দেয়া।
৬. যদি কোন নির্জন স্থানে হেনস্থার শিকার হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে অবশ্যই নিজের নিরাপত্তাকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেয়া।
৭. নিজের বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ করতে হবে।
৮. কেউ আক্রমণ করলে তাকে শক্তভাবে প্রতিহত করার চেষ্টা করা।
৯. শারীরিক ও মানসিক ভাবে শক্ত-সামর্থ্য হওয়া খুবই জরুরী।
১০. পরিবারকে এগিয়ে এসে তাদের কন্যাসন্তানদের শারীরিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে সাহায্য করতে হবে।