প্রাচীনকাল থেকেই মানব সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতা বিদ্যমান । মানবচরিত্রের চিন্তাধারার সাথে বিষয়টি এখন অনেকটাই সম্পর্কিত। স্বভাবতই একজন পুরুষ তুলনামূলকভাবে নারী হতে বেশি পেশী শক্তি বহন করে একারণে উন্নত চিন্তাবিহীন সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতা খুব সহজেই বিস্তার করে। সমাজের এ বাস্তবতায় শিক্ষার অভাব অনেকক্ষেত্রে ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় । নারীরা প্রকৃত শিক্ষার আলোতে আলোকিত না হওয়ার কারণে সমাজে নারী পুরুষের যে ভেদাভেদ তা যেন সোনায় সোহাগা হয় পুরুষের জন্য।
যে সমাজে পুরুষতান্ত্রিক চেতনার বিস্তার সে সমাজের কোনো আইনই নারীকে তার সঠিক প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে পারবে না হয়তো মিডিয়ার চোখে কিছু সফল মামলা দেখে আমরা পুলকিত হব, হাততালি দেব, কিন্তু অন্তরালে নারীরা ঠিকই বৈষম্যের শিকার হবে। এই অবস্থার যেন শুরু আছে শেষ নেই। যুগের পর যুগ ধরে যেন এই ধারা অব্যাহত আছে।পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে, নারীরা শুধুমাত্র সম্পত্তিতে অধিকারের ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার হয় তা না বরং তারা শিকার হয় বিভিন্ন  ঘরোয়া সহিংসতা, যৌন নির্যাতন ও এসিড-সন্ত্রাসের মত বিভিন্নমুখী বৈষম্য ও নির্যাতনের।
বহুকাল ধরেই সমাজ ও রাষ্ট্র অনেকক্ষেত্রেই নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ দেখিয়ে আসছে। এই সমাজ বা রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত নারীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। নারীরা সার্বিকভাবে পরাজিত, দুর্বল হয়ে থাকছে পুরুষতন্ত্রের কাছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ প্রতিনিয়ত নারীকে জৈবিক-মানসিকভাবে দমন করছে। পুরুষতন্ত্র বলতে এমন একটি কর্তৃত্ববাদী সমাজব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে পুরুষই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীকে ক্ষমতাহীন করে রাখা হয়। তাছাড়া এই সমাজব্যবস্থার ভিতরে রাষ্ট্র এমন এক শক্তি যা পুরুষতন্ত্রকেই ধারণ করে আর এই পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সবসময় পুরোপুরিভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পুঁজিবাদ হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের বিকল্প রূপ। অন্যভাবে বলতে গেলে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ প্রত্যক্ষভাবে পুরুষতন্ত্রকেই প্রভাবিত করে। এই পুরুষতন্ত্র হলো পুঁজিবাদের গভীরতম,হীনতম,জঘন্যতম শোষণের জালের ভিত্তি কিংবা হাতিয়ার। আর এই ভিত্তি বা হাতিয়ারের কারণেই নারীরা আজ এতটা পিছিয়ে পরেছে। তাই প্রয়োজন পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন। যা ভবিষ্যতে নারীমুক্তির পথকে সম্প্রসারিত করবে।
এই নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম মূলত সমাজের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। বৈষম্যের বিরুদ্ধে এই লড়াই পুঁজিবাদকেও আঘাত করে। তাই নারীমুক্তির আন্দোলন ব্যতীত পুরুষতন্ত্র তথা পুঁজিবাদ ধ্বংস হবে না। মার্কসীয় নারীমুক্তি আন্দোলনে শ্রেণি বিভক্ত সমাজকে নারীর পরাধীনতার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী নারীদের পরাধীনতা শুরু হয়েছে দাস প্রথারও অনেক আগে থেকে। এই ধারার মূল লক্ষ্য হচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামো এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা উচ্ছেদ করা। এ প্রক্রিয়ায় নারীর অধিকার আদায় করা সম্ভব। কার্ল মার্কস, ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, ভ্লাদিমির লেনিন, ক্লারা জেটকিন, আলেকজান্ডার কোলনতাই প্রমুখ মার্কসীয় নারীমুক্তি আন্দোলনকে শক্তিশালী করেন। নারীমুক্তির এই আন্দোলনকে পুঁজিবাদী এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে আন্দোলনও বলা চলে। সমাজের বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকে বদলাতে না পারলে নারীমুক্তি একেবারেই অসম্ভব। যদিও এমন বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলে আসছে দীর্ঘকাল ধরে কিন্তু তবুও যুগে যুগে সমাজ প্রগতির এই লড়াইয়ে যে ধরনের সাংস্কৃতিক জাগরণ পরিলক্ষিত হওয়ার কথা ছিল প্রকৃতপক্ষে তা হয়ে ওঠেনি। ফলে সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা চাইলেই বদলানো যাচ্ছেনা আর তাছাড়া এটাও লক্ষনীয় যে, নারীরা নিজেরাই নিজেদের অধিকার বা পাওনা সম্পর্কে সচেতন নয়। অনেকেই খুব স্বল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বিভিন্ন কলকারখানায় কাজ করে থাকেন এমনকি বহু উন্নত পুজিঁবাদী দেশেও এমনটা দেখা যায়। প্রতি পদে পদে তাদেরকে ঠকানো হচ্ছে। শ্রমের ন্যায্য পারিশ্রমিক তারা পান না। তাই এই শ্রম দাসত্ব আর পতিতাবৃত্তি হলো তাদের জন্য এক জঘণ্য অভিষাপ যা প্রসার লাভ করেছে শ্রেণী বিভক্তি থেকে। এই সমাজের উঁচু তলার লোকেরা অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় নিচুতলার মানুষের রক্তশোষণ করে যাচ্ছে প্রতিমূহুর্তে। অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবে আর শোষক শ্রেণীর নিজস্ব  প্রয়োজনে সব ধরনের আদর্শ ও নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে তারা তাদের এই শোষন প্রক্রিয়াকে টিকিয়ে রাখার জন্য শ্রমজীবি নারী সমাজের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে।
এখন এই সমাজ ব্যবস্থার অবসান করতে হলে একমাত্র পথই হলো শ্রেণী সংগ্রাম। এই শ্রেণি সংগ্রামের মাধ্যমে শ্রমজীবী নারীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সুকৌশলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে ছুড়ে ফেলতে হবে। কেননা এক্ষেত্রে যেকোন ভিন্নমত বা বিচ্ছিন্ন প্রবনতা এই শ্রেণী সংগ্রামকে বিভক্ত করে ফেলবে। অন্য যে কোন প্রকারের ভিন্নমত প্রদর্শনকারীদের এই প্রতিক্রিয়াশীলতাও এই আন্দোলনকে ব্যহত করবে।