নারী নির্যাতনের সাথে যে পুরুষতান্ত্রিক মৌলবাদী শাসনতন্ত্র জড়িত আছে
সে বিষয়ে বাংলাদেশের মুসলিম সমাজ প্রচণ্ড উদাসীন। শুধু মাত্র নারীকে
সন্তান উৎপাদন এবং শারীরিক চাহিদা মেটাবার জন্যই নারীর জন্ম হয়েছে সে
বিষয়ে আমাদের বঙ্গালাদেশের মৌলবাদী সমাজ এই বিষয়ে বিশেষ ভাবে জোর
দিয়ে নারীদেরকে অবহেলিত করে রেখেছে যুগের পর যুগ। আমাদের মত যারা
শিক্ষিত এবং এই সকল মিথ্যা সমাজ ব্যাবস্থাকে মানতে চাই না, আমাদের এই
প্রতিবাদের অস্র হল আমাদের এই কলম।
নারী নির্যাতন এবং নারী সমস্যার সঙ্গে যে ধর্মীয় মৌলবাদের ঘনিষ্ঠ
সম্পর্ক আছে এ বিষয়টি বিশেষ আলোচনায় আসেনি। মৌলিক আলোচনায় গেলে
বলতে হয়, নারীর অধস্তন অবস্থার জন্য দায়ী শ্রেণীসমাজ। ইতিহাসে
শ্রেণীবিভক্ত সমাজের উদ্ভবের ঠিক আগে আগে ব্যক্তিগত সম্পত্তির
জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই নারী জাতি হারিয়েছে স্বাধীনতা- যাকে এঙ্গেলস
বলেছেন, (পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি) নারীর বিশ্ব-
ঐতিহাসিক পরাজয় পুরুষ ঘরের মধ্যেও কর্তৃত্বের লাগামটি ধরল, নারী
পদানত হলো, দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হলো।
সামন্ত সমাজে নারী নির্যাতনের রূপটি ছিল খুবই কদর্য। পুঁজিবাদ
তুলনামূলকভাবে ভালো, যদিও বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রগুলোর সবচেয়ে
গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রেও নারী থেকে যায় প্রথমত, পূর্ণ অধিকারহীন হয়ে,
কারণ আইন তাদের পুরুষের সঙ্গে সমতা দেয় না, দ্বিতীয়ত এবং এইটাই
প্রধান কথা, সবচেয়ে তুচ্ছ, সবচেয়ে হীন, সবচেয়ে হাড়ভাঙা, সবচেয়ে বিমূঢ় করা
রান্নাবান্নার কাজ এবং সাধারণভাবে একঘেয়ে সাংসারিক ঘরকন্নায় পীড়িত
হওয়ায় তারা থেকে যায়,ঘরোয়া দাসত্বে,সাংসারিক বাঁদি হয়ে। [লেনিন]
আমাদের দেশে পুঁজিবাদ বেশ বিকাশ লাভ করলেও, তা করেছে বিকৃত আকারে।
উপরন্তু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সামন্ত বৈশিষ্ট্য এখনো প্রাধান্যে
আছে। ধর্মীয় মৌলবাদ সামন্তবাদী ও সবচেয়ে পশ্চাৎপদ চেতনার
প্রকাশমাত্র। সে কারণে নারীরা দলে দলে শ্রমবাজারে এলেও এবং সর্বাধিক
বড় শিল্প গার্মেন্টের আশি শতাংশ শ্রমিক নারী হওয়া সত্ত্বেও পারিবারিক
জীবনে সামন্ত ধ্যান-ধারণার প্রাধান্য রয়েছে। ধর্মীয় মৌলবাদ তাই এত
সহজে বিস্তার লাভ করতে পারে।
প্রকৃত নারী স্বাধীনতা এবং নারী-পুরুষের সমতা অর্জিত হয়েছিল
সমাজতান্ত্রিক সমাজে। রাশিয়ার অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ঠিক
এক বছর পর লেনিন দাবি করেছিলেন, যেসব কারণে নারীরা অধিকারহীন থাকে,
ইতিহাসে এই প্রথম তা সব নাকচ করে দিয়েছে আমাদের আইন।(রচনা
সংকলন, মস্কো, ইংরেজি, খণ্ড ২৮, পৃষ্ঠা ১৬০-৬২) কিন্তু তারপরও
পশ্চাৎপদ ধর্মীয় চিন্তা, কুসংস্কার ও অভ্যাস নাছোড়বান্দার মতো লেগে
থাকে। সে জন্য লেনিন উক্ত রচনায় এর পরপরই বলছেন, গ্রামাঞ্চলে এখনো
গির্জা বিয়ের প্রাধান্য, পুরোহিতদের প্রভাবের জন্য তারা এতে বাধ্য হন এবং
পুরনো আইনের চেয়ে এই অভিশাপটার সঙ্গে লড়াই করা বেশ কঠিন।নারী
মুক্তির ক্ষেত্রে ভাবাদর্শগত সংগ্রাম খুবই জরুরি। আমাদের দেশে যেখানে
সমাজতন্ত্র তো দূরের কথা, পুঁজিবাদও পূর্ণ বিকাশ লাভ করেনি, যা করেছে
তাও আবার বিকৃত পথে, যেখানে সামন্ত ধ্যান-ধারণা রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারে
খুবই প্রবল সেখানে সত্যিকারের নারী স্বাধীনতা ও নারী-পুরুষ সমতা অর্জন
করতে হলে পশ্চাৎপদ ও মৌলবাদী ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা খুবই
জরুরি। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নারী আন্দোলন দ্বারা এই
সংগ্রামকে তীব্র করতে হবে।
দুই. ধর্মীয় মৌলবাদ হলো ধর্মের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ব্যাখ্যা, যা যুগের
সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মীয় বিধিবিধানের সংস্কারকে মানতে চায় না। দ্বিতীয়ত,
মৌলবাদী সংগঠনগুলো মনে করে তারা যেভাবে ধর্মের ব্যাখ্যা দেবে সেটাই
সবাইকে মানতে হবে এবং সে জন্য তারা সন্ত্রাস ও বল প্রয়োগের আশ্রয়
নেয়।
ধর্ম কীভাবে নারী নির্যাতনের হাতিয়ার হয়েছিল তার কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া
যাক। ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত হিন্দু সমাজে সতীদাহের মতো বর্বর প্রথা
চালু ছিল। মধ্যযুগে ইউরোপে ডাইনি বলে কত নারীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল
ধর্মের নামেই, চার্চের নির্দেশে। হিন্দু ধর্মের ভগবান শঙ্করাচার্য স্পষ্ট
করেই বলেছিলেন, নরকের দ্বার হচ্ছে নারী। বাইবেলে বলা আছে, নারী হচ্ছে
রুট অফ অল ইভিল। ইসলাম ধর্ম তুলনামূলক প্রগতিশীল হলেও এখানেও
নারীকে পুরুষের অধীনস্থ রাখা হয়েছে। মুসলমান সমাজে নারী শিক্ষার
প্রবর্তক মহীয়সী বিপ্লবী নারী বেগম রোকেয়া তাই বলেছেন, ;আমাদের
যথাসম্ভব অধঃপতন হওয়ার পর দাসত্বের বিরুদ্ধে কখনো মাথা তুলিতে পারি
নাই; তাহার প্রধান কারণ এই বোধ হয় যে, যখনই কোনো ভগ্নী মস্তক
উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন-রূপ
অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে।… আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার
জন্য পুরুষগণ ওই ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ
করিয়াছেন।… এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ-রচিত বিধি ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই
নহে।
আর একবিংশ শতাব্দীতেও কলকাতার কলেজের অধ্যাপিকা মীরাতুন নাহার
বলছেন, মুসলমান সমাজের পুরুষের স্বার্থপরতা মেয়েদের বন্দী হতে বাধ্য
করেছে। ধর্মীয় বিধিনিষেধ আরোপের ক্ষেত্রে মেয়েরা ক্রীড়নকে পরিণত
হয়েছে। যত বিধিনিষেধ তাদের ওপর। পুরুষ স্বাধীন। মেয়েরা বন্দী। নারী-পুরুষের
জৈবিক সম্পর্ককে মুসলমান পুরুষ সমধিক গুরুত্ব দেয়। উভয়ের সম্পর্ক যেন
ভোক্তা ও ভোগ্যের। সে কারণে কঠোর পর্দাপ্রথা।
এখনকার আরেক ভারতীয় মুসলিম নারী লেখিকা ও বুদ্ধিজীবী রোশেনারা খান
লিখেছেন, ইসলাম ধর্ম বয়সে সর্বাপেক্ষা নবীন এবং তৎকালীন পরিস্থিতির
পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই আধুনিক।… কিন্তু ধর্ম যত প্রাচীন হয়েছে
সংস্কারের অভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তার অবাঞ্ছিত শাখা-প্রশাখা। ধর্মের নামে
গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য আগাছা।
বাংলাদেশের অনেক লেখিকার এরূপ উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে। আমাদের এখন
দরকার মুসলিম সমাজে বড় ধরনের সংস্কার। পারিবারিক আইনকেও
গণতান্ত্রিক করতে হবে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হল আমাদের বাংলাদেশের নারীরা এই পুরুষতান্ত্রিক
সমাজের বিরুদ্ধে কথা বলতে এত ভয় পায় যে তারা প্রতিবাদের প্রয়োজন মনে
করে না। কিন্তু কেন করে না আমার বোধগম্য হয় না। হয়ত অসহায় নারীর আর
কোথাও যাবার জায়গা নেই তাই হয়ত। কিন্তু যুগের পর যুগ এই নারীর
অসহায়ত্বর সুযোগ নিয়ে এখন করে চলেছে এই বর্বর নির্যাতন।এর শেষ
কোথায় আমার জানা নেই। পত্রিকা খুললেই দেখি এই অসহায় নারীদের হত্যার
খবর। কেউ প্রতিবাদ করে না। তাই এই খুনের বিচারও হয় না।