ছোট্ট মামনি,
আমি জানিনা হয়ত তুমি আমার কোন জনমের সন্তান ছিলে, হয়তোবা আমার মা ও হতে পারো, বলতে পারিনা! যখনই আমি তোমার সুন্দর ছোট্ট এই মুখটা দেখি, তখনই আমার পুরো পৃথিবীজুড়েই জেনো সোনা ঝরে! আমাকে দেখে যখনই তুমি হাসো, তখন যেন আমাদের চারিপাশ এক নির্মল আলোর ঝলকে আলোকিত হয়ে ওঠে। আর যখন তুমি তোমার চোখগুলোর দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে জলজল করে তাকাও এবং বিনা কারনে বায়না ধরো, তখন মনে হয় পৃথিবীর সকল কিছু উজাড় করে তোমার জন্য সব কিছু নিয়ে আসি!
যখনই তুমি সুন্দর পরিপাটি জামা-জুতা পরে আমার বারান্দায় খেলতে আসো তখন আমার কি যে আনন্দ হয় তা আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। যখন আমার সযত্নে লালন করা গাছ থেকে টুক করে ফুলটি ছিঁড়ে দৌড়ে পালিয়ে যাও, বিষাস করো, আমার কিন্তু একটুখানিও খারাপ লাগেনা। তুমি কি জানো, গাছ গুলোকে আমি অনেক যত্ন করে রাখি, কাউকে কাছে ধারেও ঘেষতে দেই না। কিন্তু শুধু তুমি হাত দিলেই আমার খারাপ লাগে না। কারন কি জানো? এসকল গাছ গুলো থেকেও তুমি অনেক সুন্দর, অনেক কোমল। আমার মনে হয় তুমি আসলে একটা পরী, ভুল করেই এই পৃথিবীতে চলে এসেছো!
তুমি আমার কন্যা নও, কিন্তু তোমাকে দেখলেই কেন জানি আমার মায়ের কথা খুব মনে পরে। আর তাই তোমাকে নিয়ে খালি চিন্তা হয় আমার, ভেবে ভেবে মাঝে মাঝেই ঘেমে উঠি, আতংকে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।
তোমার জন্য হয়তো আমি কোন সুন্দর পৃথিবী দিয়ে যেতে পারবো না। তোমার জন্য কোন সুন্দর অপেক্ষা করে নেই, কোন রঙ্গিন পৃথিবী নেই। এই পৃথিবীটা বড্ড বেশি নোংরা আর ঘিনঘিনে, কালো অন্ধকারের মত। এটা তোমার জায়গা নয়, তুমি ভুল সময়ে ভুল করে এখানে চলে এসেছো।
কদিন পরেই তুমি বড় হবে, তোমার শরীর বাড়বে, তোমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। শৈশবের কোমল শরীর ছেড়ে তুমি প্রজাপতির মত উড়ে যেতে চাইবে, ডানা মেলতে চাইবে আকাশে।
কিন্তু ঐ আকাশ বড় বেশি কদর্য। ওখানে শকুনেরা বসবাস করে। তোমাকে তারা কালো কাপড় দিয়ে মুড়ে দেবে, ঠিক যেন তুমি একটি বস্তা, একটি পদার্থ। একটা কলা। একটা মিস্টান্ন। একটা তেঁতুল।
ওরা তোমাকে বোঝাবে, তুমি একটি রসালো খাদ্যবস্তু, তোমাকে দেখলেই হায়নারা তোমার উপরে হামলে পরবে। তোমাকে ছিঁড়ে খুড়ে খেয়ে নেবে। তাই তোমাকেই ঢেকে ঢুকে থাকতে হবে! তুমি বলতে পারো কেন তোমাকে এমন কালো কাপড়ের মধ্যে বসবাস করতে হবে, কেন তুমি রাস্তায় আর দশটা ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলতে পারবে না?
না, তোমার সেই অধিকার নেই। তুমি হচ্ছ “মেয়ে মানুষ”! মানুষের একটি ভিন্ন প্রজাতি, যা পুরুষের চাইতে শত নিকৃষ্ট। পুরুষের ভোগের জন্য, তার নিঃসঙ্গতা কাটাবার জন্যেই তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তুমি আসলে সৃষ্টির মুল উদ্দেশ্য নও, সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্যের একটি উপকরণ মাত্র। মহান আল্লাহ তালাহই তা বলে দিয়েছেন।
আমাদের সমাজের পুরুষগুলো তোমাকে দেখা মাত্রই উত্তেজনা বোধ করতে পারে। তুমি হচ্ছ “একটি কলা”, যাকে পুরুষেরা “ছিলা” অবস্থায় দেখলেই কামড় বসাতে চাইবে। তুমি হচ্ছে একটি তেঁতুল, যাকে দেখলেই তাদের মুখ থেকে লালা বেরুতে থাকবে। তুমি হচ্ছ “একটি পাত্রে রাখা মিষ্টি”, পাত্রটি ঢেকে না রাখলে “তোমার উপরে মাছি বসবেই”!
তুমি বলতে পারো, পুরুষেরা উত্তেজিত হবে, সে জন্য তোমাকে কেন কালো কারাগারে জীবন পার করতে হবে? আর কেনই বা পুরুষগুলো উত্তেজিত হবে? তারা সকলেই কি এক একটি ধর্ষক, হায়না, যে তোমাকে কালো বস্তার ভেতরে না দেখলেই ঝাঁপিয়ে পরবে? কিন্তু তুমি কোন প্রশ্ন করো না সোনামনি। কারণ আমাদের সমাজে প্রশ্ন করা মহাপাপ।
একটি ইট ঘাসের উপরে রেখে দিলে কিছুদিন পরেই সবুজ সতেজ ঘাসগুলো যেমন হলুদ আর ঘিনঘিনে হয়ে ওঠে, তোমার সতেজ চেহারাটাও আস্তে আস্তে ঘিনঘিনে আর হলুদ হয়ে উঠবে। তুমি আস্তে আস্তে পাল্টে যাবে, শিখে নেবে যে তুমি আদৌ “মানুষ” প্রজাতির কেউ নও। তুমি হচ্ছ গিয়ে “মেয়ে মানুষ”! আমাকে তুমি ক্ষমা কর মামনি।
তুমি হয়তো বড় হয়ে কোন ছেলেকে ভালবাসতে চাইবে, তার সাথে রিকশায় ঘুরতে ঘুরতে গান গাইতে চাইবে, কিন্তু খবরদার, ঐ কাজটিও করো না। এরকম করলে তারা তোমাকে দোররা মারবে, মাটির ভেতরে অর্ধেক পুঁতে পাথর ছুড়ে তোমার শরীর ছিন্ন ভিন্ন করে দেবে।
তোমাকে হয়তো কোনদিন হায়নাগুলো আক্রমণ করবে, তোমার সুন্দর শরীরটা ভেঙ্গে চুড়ে ছিঁড়ে খেয়ে নেবে। তখন আমাদের ভদ্রলোকেরা তোমাকেই চরিত্রহীন আর “যৌন বিকারগ্রস্থ” বলে প্রমাণ করে দেবে। তোমার জামা কাপড়ের ঠিক নেই, এত রাতে বাইরে কী করছিলে, ইত্যাদি নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তোমায়। বরঞ্চ, তোমাকেই দোষী সাব্যস্ত করবে আল্লাহর ঐশ্বরিক আইন। তোমাকে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলার সময় তারা “আল্লাহো আকবর” ধ্বনিতে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ফেলবে।
তুমি একদিন লাল টুকটুকে জামা আর তোমার প্রিয় লাল জুতো জোড়া পরে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলে। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম তোমাকে যে কত্ত সুন্দর লাগছে। তোমাকে সুন্দর লাগছে তা বলতে, এটা বলিনি বলে গাল ফুলিয়ে কি কান্নাটাই না কেঁদেছিলে। পরে তোমাকে অনেক অনেক চুমু দিয়ে রাগ ভাঙ্গাতে হয়েছিল।
এমন করেই হয়তো তুমি একদিন চাইবে, সবাই তোমাকে সুন্দর বলুক, সবাই তোমার খুব প্রশংসা করুক। তুমি হয়তো তোমার প্রিয় জামাগুলো পরবে, সবাইকে দেখাবে তুমি কত সুন্দর। এটা কোন অপরাধ নয়, তুমি চাইতেই পারো লোকে তোমাকে সুন্দর বলুক।
কিন্তু আমাদের অন্ধকারের সমাজে এতো মহাপাপ। জানো না, সেদিনও একটি ফুটফুটে মেয়েকে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য ওরা পাথর ছুড়ে মেরে ফেলেছিল? লোকে বলবে তুমি তোমার রূপ দেখিয়ে পুরুষকে আকর্ষণ করতে চাইছো! মানুষের ঈমান ধ্বংস করতে চাইছো!
তুমি হয়তো অনেক বেশি পড়ালেখা করে, অনেক মেধাবী হবে। কিন্তু তুমি যতই পড়ালেখা কর না কেন, যতই মেধাবী হও না কেন, তোমাকে একজন পুরুষের নিচেই থাকতে হবে। হোক না সে তোমার জুতোর চেয়েও নিকৃষ্ট, তবুও তুমি তার উপরে থাকতে পারবে না।
অথবা একদিন হয়তো তোমার বিয়ে হবে, তুমি হয়তো এলাকার কোন ধর্মীয় নেতার চতুর্থ স্ত্রী হবে। তোমার চাইতে হয়তো ৪০ বছরের বড় তোমার স্বামী নামক পশুটি বিয়ের রাতেই বিসমিল্লাহ বলে তোমার উপরে হামলে পরবে তার সর্বশক্তি নিয়ে। তোমাকে দলিত মথিত করে, আচড়ে কামড়ে ছিড়েবিড়ে ফেলবে সেই ধর্মপুত্রটি।
তোমাকে ক্রমশই তারা শষ্যক্ষেত্রে পরিণত হবে, তোমাকে চাষাবাদ করা হবে, তোমার ভেতরে পাক পবিত্র বীজ বপন করা হবে, যেন সেখান থেকে পাক পবিত্র ঈমানদার ফসল উৎপন্ন হয়!
তারপরেও তুমি ভেব না তোমার কষ্টের দিন শেষ হয়ে গেছে। এতো সবে শুরু। যতটা দিন তুমি বেড়ে না উঠছো, পৃথিবীর রঙ রূপ উপভোগ করে নাও। আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে শরীয়া আইন, আমি হয়তো তোমাকে বাঁচাতে পারবো না সোনা আমার।
হ্যাঁ, তোমার জন্ম হচ্ছে একটি “পাপ”; এবং তুমিই হচ্ছ স্বর্গ থেকে পতিত মানুষের সমস্ত দুর্দশা দুর্গতির একমাত্র কারণ। তুমি না থাকলে আজকে আমাদের ধর্মপুত্ররা স্বর্গের বাগানে অসংখ্য হুরীর কোলে দোল খেতো, কিন্তু তোমার কারণেই তারা আজ স্বর্গ থেকে বিতাড়িত। তাই এর প্রতিশোধ তারা সুদে আসলে তোমার থেকে আদায় করেই ছাড়বে। ধর্মপুত্রদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হবার দায়ভার একেবারেই তোমার, এবং তোমাকেই এর মাসুল গুণতে হবে।
তুমি কি আমাদের এই অপদার্থতা কিংবা অক্ষমতাকে ক্ষমা করতে পারবে মামনি? আমি চাইলেও যে তোমাকে এই অভিশাপ থেকে বাঁচিয়ে সুন্দর সুস্থ জীবন উপহার দিতে পারবো না। তুমি কি পারবে আমার এই অপারগতাকে ক্ষমা করে দিতে? তোমার জন্য এই পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বাচার জন্য পরিবেশ তৈরি করে দিতে পারিনি বলে কি আমায় ক্ষমা করবে? তবে আমি আমরণ চেষ্টা করে যাবো যাতে করে কেউ তোমাকে ‘মেয়ে মানুষ’ বলতে না পারে। আমি চেষ্টা করে যাব তোমার জন্য নিরাপদ একটি পৃথিবী তৈরি করতে। আমি চেষ্টা করবো তুমি যাতে মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াতে পারো, মন চাইলে যাতে বৃষ্টিতে ভিজতে পারো, ইচ্ছে হলেই যেন নিঃসঙ্গ রাতে নিরাপদে আকাশে চাঁদ কিংবা তারা দেখতে পারো।
আমার অপদার্থতা, নপুংসক অক্ষমতা তুমি ক্ষমা কর সোনা। তোমাকে হয়তো আমি এই অভিশাপ থেকে বাঁচাতে পারবো না। আর তাই কামনা করছি, তুমি বেড়ে ওঠার আগেই মরে যাও, পৃথিবীর নোংরামী যেন তোমাকে স্পর্শ করতে না পারে। তুমি শুদ্ধ শুভ্রই থেকে যাও, তোমার পৃথিবী থাকুক স্বপ্নের মত সুন্দর, যেখানে তোমাকে সবাই “মানুষ” বলবে, যেখানে কেউ তোমাকে শস্যক্ষেত্র বানাতে পারবে না, যেখানে অন্যের উত্তেজনার কারণে তোমাকেই শাস্তি পেতে হবে না, যেখানে তোমাকে কেউ “মেয়ে মানুষ” বলবে না। তুমি সেখানে মুক্ত পাখির মত উড়ে বেড়াতে পারবে, বৃষ্টিতে ভিজে গান গাইতে পারবে। কেউ তোমাকে এজন্য পাথর মারবে না, দোররা মারতে চাইবে না।
ছোট্ট মামনি আমার, ক্ষমা করবে আমাকে?