সমকামিতা নিয়ে বিজ্ঞান কি বলে, এই বিষয়টা একজন ডাক্তার হয়ে জাকির নায়েক বিষয়টি বোঝেন না। উনি বুঝতে চান না। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। একজন  ডাক্তার হয়ে জিনগত বৈশিষ্ট্য ও সমকামিতার বিষয়টি  একে ওপরের সাথে অতপ্রত ভাবে জড়িত উনি সে বিষয়টি নিয়ে কোনদিনও খোলা মেলা ভাবে আলোচনা করেন নি। একজন বিজ্ঞান পড়ুয়া মানুষ যিনি আবার ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ সেখানে বিজ্ঞানকে আলাদা করে ধর্মীয় কুসংস্কারআচ্ছন্ন বিষয়গুলোকে সামনে তুলে ধরে উনি ওনার সেমিনারে মানুষদেরকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। মানুষও বোকা উনি যাই বলেন টাই বিশ্বাস করে ওনাকে অন্ধের মতো ভক্তি করে। 

সমকামিতা বাংলাদেশের গ্রাম্য সমাজে প্রায় অজ্ঞাত এক নাম, সেকুলার সমাজে এ যেন গা ঘিনঘিনে বা অস্পৃশ্য কোনো বিষয়। তাই এলিট সমাজে অনুচ্চারিত এক শব্দ। এই সবকিছুর মধ্যে; নাম নেওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামী সমাজে এটি তুলনামূলক ভালো অবস্থানে আছে। সেখানে ঢাকঢোল পিটিয়ে বলে দেওয়া হয়, মিথোলজিক্যাল গল্পের কথা। ক্ষণে ক্ষণে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, আসমানী গজবের কথা। আর ইতিহাসের সেই পৌরাণিক গল্পকে সামনে রেখে; সমকামিতা বাস্তবে কী, তা না বুঝেই এটি কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাই সমকামিতা নিয়ে যুক্তিপূর্ণ কোনো আলোচনা রাখতে গেলে যদি দেখা যায় কারো বক্তব্য সমকামিতার পক্ষে যাচ্ছে; তাহলে সেও হয়ে উঠতে পারে ধর্মের ধ্বজাধারীদের কাছে চক্ষুশূল। যার প্রমাণ দেখা গিয়েছিল অভিজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে। সমকামিতা নিয়ে বাংলা ভাষায় প্রথম বৈজ্ঞানিক নিরিখে লেখা বইয়ের জন্য অনলাইনে তাকে ক্রমাগত গালিগালাজের শিকার হতে হয়েছিল। যার পরিণতি গিয়ে শেষ হয়েছিল তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে। এই যে সমকামিতা আর সাধারণ ধার্মিকদের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব বাংলাদেশে বিরাজমান; তা দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সাধারণ মানুষ বুঝি, সমকামিতা সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণার সকল ধারণা রাখেন। কারণ, আপনি যখন কোনো কিছুর বিরোধী হয়ে উঠবেন; তাই রাজনীতিবিদদের মত বিরোধ করার জন্য হলেও সে সংক্রান্ত সকল তথ্য আপনার নখদর্পণে থাকা চাই। কিন্তু আসলে তা নয়, বাংলাদেশের মানুষের কাছে সমকামিতা সংক্রান্ত যে খবর টা আছে, তা হলো – সমকামিতা জীনগত নয়, এতটুকুই। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কিভাবে এই তথ্যটা জানে; তা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। আধুনিক ধারার পোশাক পরা ডিজিটাল যুগের ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ জাকির নায়েকের কথা এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। গল্পটা বলেই ফেলি:

একবার একজন মুসলিমা জাকির নায়েককে বিবর্তনের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। জাকির নায়েক সেই প্রশ্নের উত্তরে বিবর্তনকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন নানান ধরনের তথ্য দিয়ে। যদিও অনেকে বলেন, জাকির নায়েক ৭ মিনিটে অন্তত ২৫ টা ভুল করেছেন। কিন্তু সে অন্য কথা। বিবর্তন সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে জাকির নায়েক উত্তরের শেষাংশে অযাচিতভাবে সমকামিতাকে টেনে এনেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “একবার গবেষণায় দেখানো হলো: সমকামিতা জিনগত, অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, যদি সমকামিতা জিনগত হয়; তাহলে তো একে নিষিদ্ধ করা যাবে না, পাশাপাশি সমকামীদের ও কোনো দোষ নেই। কারণ এটা তাদের জন্মগত। আমি তাদের বললাম, দাঁড়াও অপেক্ষা করো। এর কিছুদিন পরে দেখা গেল, সমকামিতার সাথে জীনের কোনো সম্পর্ক নেই এবং দেখা গেল, যে এ আবিষ্কারটা করেছে; সে নিজেই সমকামী।” এরপর জাকির নায়েক এক মুচকি হাসি দিলেন। দিয়ে বললেন, একশ বছর পরে হলেও বিবর্তন তীব্রভাবে ভুল প্রমাণিত হবে। (সমকামিতা সংক্রান্ত অন্যান্য প্রায় বক্তব্যে তিনি এই উদাহরণ দিয়েছেন)

পাঠক এর মাধ্যমে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, এর গবেষক নিজে সমকামী হওয়ায় ইচ্ছাকৃতভাবে এ হেন কাজ করেছেন। যদিও সেই গবেষকের নাম উচ্চারণ করা হয় নি। তবুও ধরে নেই, ১৯৯৩ সালে ডিন হ্যামারের গবেষণাটিকে ঈঙ্গিত করেছেন। মজার বিষয় হলো, ডিন হ্যামার যে কোনো ছলচাতুরীর আশ্রয় নেন নি, তা রাষ্ট্রীয় ভাবে তদন্ত করেই দেখা হয়েছে। এরপর দুইটি গবেষণায় হ্যামারের বিপরীত ফলাফল আসলেও ২০১৪ সালে একটি বিস্তৃতপরিসরে করা গবেষণায় হ্যামারের ফলাফলকেই তা সমর্থন করে। সেই সময় থেকেই বৈজ্ঞানিক ও সচেতন মানুষের কাছে সমকামিতা যে জীনগত ব্যাপার তা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের মানুষ সমকামিতার সাথে জিনগত সম্পর্ক আছে কি নেই, তা নিয়ে অর্ধসত্য জানলেও এটা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে গবেষণা কিন্তু থেমে নেই। সমকামিতার সাথে শরীরের প্রত্যঙ্গের সম্পর্ক, বড় ভাইয়ের সম্পর্ক, পারিপাশ্বিক সম্পর্ক, বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পর্ক ইত্যাদি ইত্যাদি গবেষণা হয়েছে। যার সিংহভাগই গেছে সমকামীদের পক্ষে। ২০১৪ সালের প্রখ্যাত গবেষণা থেকে এই বিষয়টা নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল যে, সমকামিতার সাথে জিনগত সংযোগ আছে; কিন্তু কোন জিন, তা এতকাল জানতেন না বিজ্ঞানীরা। তাই সাধারণ সমকামী বিদ্বেষী মানুষের কাছে; এ ছিল স্বস্তিদায়ক। কিন্তু বিধিবাম! এক নতুন তথ্য পূর্ব দিগন্তের আলোয় প্রতিভাত হয়ে উঠতে চলেছে।

সময়ের সাথে সাথে মানুষ সমকামিতা সম্পর্কে জানতে পারছে। অনেকে আছেন যারা বিষয়টি নিয়ে কথাও বলছেন। আবার অনেকেই বিষয়টা স্বীকার করে নিয়েছেন। আবার অনেকেই আছেন যারা বিষয়টিকে মান্যতা দিয়েছেন কিন্তু ভয়ে সমাজের সামনে মুখ খোলেন না। কারণ সমাজের বিরুদ্ধে কথা বললে সমাজচ্যুত হবার ভয়ে স্বাভাবিক ভাবে জীবন যাপন করতে পারবেন না। আমাদের সমাজটা ধর্মীয় গোঁড়াপন্থির এক আদ্যোপান্ত কাহিনী নিয়ে বানানো। যেখানে ধর্মের বাইরে কোন কথা বললে, কাজ করলে, বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিলে সেটা হয়ে যায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। হয় আপনাকে মেরে ফেলা হবে না হয় আপনাকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে। যবন হয়ে যাবে এক যাযাবরের জীবন। না থাকবে ঘর না থাকবে দেশ।