সমকামিতা নিয়ে লেখার জন্য , ধর্ম অবমাননার জন্য প্রাণ হারালেন ডঃ অভিজিৎ রায়। ওনার প্রকাশিত বই মুক্তমনা মনের মানুষদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেলেও শেষ রক্ষা পেলেন না উনি। আমেরিকা থেকে দেশে বেড়াতে এসে দেশে মুক্ত ভাবে বাঁচতে চেয়েছিলেন। দেখতে চেয়েছিলেন প্রিয় মাতৃভূমিকে। আর সেই মাতৃভূমির মাটি তারই শরীরের গরম রক্তে ভিজে লাল হয়ে গেছে। আর সেই রক্ত শুখিয়ে মিশে গেছে সেই  মাটিতেই। আর বিচার? অভিজিৎদার খুনের বিচার আজ পর্যন্ত প্রশাসন করতে পারে নি। আমি জানি, দাদার খুনের বিচার হবে না। শুধু মাত্র মৃত্যুদিনটাই স্মরণ করে যায় কিছু হাতে গোনা মানুষ। মুক্ত মনাদের কি বাঁচার অধিকার বাংলাদেশ দেয় ?

২০১০ সালের একুশে গ্রন্থমেলায় শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত হয়েছিলো অভিজিৎ রায়ের লেখা “সমকামিতা: একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান” বইটি। বইটির ভূমিকায় অভিজিৎ রায় লিখেছিলেন- “সমকামিতা অস্বীকৃত শুধু নয়, অনেক জায়গায় আবার এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এখানে সমকামীদের হয় লুকিয়ে থাকতে হয়, কিংবা অভ্যস্ত হতে হয় ‘ক্লোসেটেড গে’ হয়ে ‘বিবাহিত’ জীবন যাপনে। তাদের অধিকার হয় পদে পদে লঙ্ঘিত। এর সুযোগ নিয়ে অনেক সময় খুব কাছের বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে ঘটে আক্রমণ আর নানা পদের হেনস্থা। ‘সনাতন বাঙালি কিংবা ধর্মীয় সংস্কৃতি’র ধারক এবং বাহকের দল আর অন্যদিকে ‘অপসংস্কৃতি’র বিরুদ্ধে সদা-সোচ্চার স্বঘোষিত অভিভাবকবৃন্দ; কারো কাছ থেকেই সমকামীরা বিন্দুমাত্র সহানুভূতি প্রত্যাশা করতে পারে না। আসলে সমকামীদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির একটা বড় কারণ আমাদের বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব। আর এ কথা বলে দেয়া নিষ্প্রয়োজন যে–সব পুরানো সংস্কৃতির মতোই আমাদের সংস্কৃতিরও অনেকটা জুড়েই বিছানো আছে অজ্ঞতার পুরু চাদর। আমাদের সংস্কৃতিতে গুরুভক্তি যেমন প্রবল তেমনি লক্ষণীয় ‘মান্য করে ধন্য হয়ে যাবার’ অন্তহীন প্রবণতা। আমরা গুরুজনদের বহু ব্যবহারে জীর্ণ আদর্শের বাণী আর অভিভাবকদের শেখানো বুলি তোতাপাখির মতো আজীবন আউরে যেতে ভালোবাসি। আমাদের ভয় অনেক। সীমাহীন স্ববিরোধ আর বংশপরম্পরায় চলে আসা প্রথা মান্য করে যাওয়াকেই আমাদের সমাজে ‘আদর্শ’ বলে চিহ্নিত করা হয়। এর বাইরে পা ফেললেই বিপদ। কিন্তু তারপরও কাউকে না কাউকে তো ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার’ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতেই হবে। এই বইয়ের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বাংলাভাষীদের জন্য অজ্ঞতার চাদর সরানোর প্রয়াস নেয়া হয়েছে, সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণ হাজির করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, সমকামিতা কোনো বিকৃতি বা মনোরোগ নয়, এটি যৌনতারই আরেকটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি।”

২০১৪ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে সমকামীদেরকে গ্রহণ করা ও বৈষম্য দূর করার অভিপ্রায়ে প্রকাশিত হয় রূপবান পত্রিকা। গে, লেসবিয়ান ও বাই সেক্সুয়াল ও ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ছিলো রূপবান পত্রিকাটির প্রকাশ। পত্রিকাটির দ্বিতীয় সংখ্যায় ছাপা হয়েছিলো মুক্তমনা সম্পাদক ও সমকামিতা বইটির লেখক অভিজিৎ রায়ের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। বাংলাদেশে সমকামিদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীর কেমন পরিবর্তন হচ্ছে জানতে চাইলে অভিজিৎ রায় আশা প্রকাশ করে বলেছিলেন- “আমি আশাবাদী। একটা সময় রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় এ নিয়ে আলোচনার কোন প্রেক্ষাপটই ছিল না। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। ফেসবুক, ব্লগ কিংবা টুইটারে মানুষ আলোচনা করছে। রাষ্ট্র চাইলেও সবার কণ্ঠরোধ করতে পারছে না। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে মেইনস্ট্রিম পত্রিকাগুলোর কয়েকটি এ ব্যাপারে লেখা ছাপাতে আগ্রহী হচ্ছেন, সেটাও দেখছি। সে লেখাগুলো দ্রুতগতিতে পাঠকদের হাতে পৌঁছেও যাচ্ছে। আমি আশা করছি অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতির অনেক উন্নয়ন হবে। সমকামীদের লুকিয়ে ছাপিয়ে থাকতে হবে না, হবে না অযাচিত আক্রমণের ভয়ে ভীত হয়ে চলতে।” 

যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন অভিজিৎ রায়, যে বাংলাদেশ গড়তে কাজ করছে অজস্র লেখক, অধিকারকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী, মুক্তমনা সচেতন মানুষ সেই বাংলাদেশ আজ ইসলামি মৌলবাদের চাপাতিতে আক্রান্ত। নিয়ম করে খুন হচ্ছেন মানবতাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল শিক্ষক, লেখক, অধিকারকর্মী। সরকার অবস্থান নিচ্ছে মৌলবাদের পক্ষেই, বেছে নিয়েছেন আক্রান্তকে দোষারোপ করে দায় এড়ানোর সংস্কৃতি। সরকার প্রধান থেকে শুরু করে পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা সবাই কথা বলছেন জঙ্গিদের সুরে। “রূপবান” পত্রিকার সম্পাদক ও অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান নিজ বাসায় বন্ধু সহ জবাই হবার পর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন-

“আমরা যতটুকু জেনেছি জুলহাজ রূপবান নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। আর তিনি সমকামীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করতেন। এটা আমাদের সমাজের সঙ্গে মানানসই না।”

আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আর আমিও আগেই বলেছি কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে বা বিশ্বাসে আঘাত দেওয়ার অধিকার অন্য কারো নেই। সবাইকে সংযত হয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করার অনুরোধ করছি ।

তবে অবশ্যই বাংলাদেশের সবাই শেখ হাসিনা নন, সবাই আসাদুজ্জামান কামালও নন, সবাই আনসার বাংলা, দাওয়াতে ইসলাম, আল-কায়েদা বা আইএস নন। উঁচু থাকা মাথারা একে একে কাটা পড়লেও প্রগতির পথ বন্ধ হবে না কখনই, বন্ধ হবে না মানবতাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, সবার অধিকারে সচেষ্ট বাংলাদেশ রক্ষার আন্দোলনও। খুন হওয়া মানবাধিকার কর্মী জুলহাজ মান্নানের প্রতি শ্রদ্ধা।

তোমাদের খুনের বিচার হবে না এই দেশের মাটিতে। তোমাদের মতো মানুষরা এদেশে বাঁচতে পারে নাই। এই দেশ তোমাদেরকে বাঁচতে দেয় নাই। চাপাতির কোপে একটার পর একটা প্রাণ শেষ হয়ে যাবে কিন্তু বিচার হবে না খুনের। তোমাদের খুনের বিচার হলে সরকার তার ক্ষমতা হারাবে। ধর্মীয় নেতারা ফুঁসে উঠবে। আরও অনেক মায়ের বুক থেকে কেড়ে নেয়া হবে তার সন্তানকে। রক্তে ভেসে যাবে বাংলার রাজপথ। আবার সেই রক্ত শুকিয়ে মাটিতে মিশে যাবে। কিন্তু বিচার আর হবে না বাংলাদেশে।