আসিফ মাহতাব ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অংশকালীন শিক্ষক, একটি শিক্ষামূলক মঞ্চে সপ্তম শ্রেণির এক পাঠ্যক্রমের সমালোচনা করেছেন, যা অবশ্যই তার ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশের অধিকারের অন্তর্গত। তবে, শুধু মতামত প্রকাশের নামে তিনি যা করেছেন, তা দেশের শিক্ষা বিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। পাঠ্যবই ছিঁড়ে তিনি না কেবল একটি শিক্ষামূলক সম্পদের অবমাননা করেছেন, বরং সমগ্র শিক্ষা প্রণালীতে একটি ভুল বার্তা প্রেরণ করেছেন। এমন কর্মকাণ্ড শুধু তার নিজস্ব মূল্যবোধেরই প্রতিফলন নয়, বরং এটি দেশের শিক্ষা নীতির প্রতি এক গুরুতর আঘাত।
যদি কেউ পাঠ্যপুস্তক ছিঁড়ে নিজের ভিন্নমত প্রকাশের প্রয়াস করে, তবে সেটি অপরের মতামতের প্রতি আক্রমণের শামিল। এমন ক্রিয়াকলাপ নিঃসন্দেহে শিক্ষামূলক অভিপ্রায়কে ক্ষুণ্ন করে এবং দণ্ডনীয় অপরাধে পরিণত হয়, যা বাংলাদেশের দণ্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তির দাবিদার।
যে শিক্ষকটি সপ্তম শ্রেণির পাঠে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিত্ব ও সমকামিতার মধ্যে অসার সংযোগ স্থাপন করে সামাজিক বিভেদ সৃষ্টি করেছেন, তিনি মৌলিক বুদ্ধি এবং যৌনতা ও জেন্ডারের পার্থক্যের বোধ থেকে বঞ্চিত। তাঁর কার্যকলাপের মাধ্যমে পাঠ্যবইয়ের উদ্দেশ্যমূলক শিক্ষা হীন মূল্যায়িত হয়েছে। ধর্মীয় শিক্ষা অনুসরণের অর্থ অন্যের মতামতের উপর অযাচিত প্রভাব চাপিয়ে দেওয়া নয়, বরং এটি প্রত্যেকের নৈতিক বিবেচনা ও ব্যক্তিগত উন্নতির পথ নির্দেশ করা উচিত।
বাংলাদেশের আইন ও শিক্ষানীতির প্রেক্ষাপটে, শিক্ষকের এই অপকর্ম LGBTQ সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করে এবং একটি শিক্ষামূলক অধ্যায়কে বিকৃত করে। যথার্থ শিক্ষা এবং উচিত বুদ্ধির বিকাশে, এই ধরনের আচরণ কেবল অস্বীকার নয়, বরং সমাজের প্রগতিশীল গতিপথে একটি বাধা।
যখন তিনি ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিত্বের সাথে সমকামিতার অযৌক্তিক সংযোগ তৈরি করেন এবং সামাজিক বিষ বিস্তার করেন, তখন তিনি যৌনতা এবং জেন্ডার বিষয়ের মৌলিক পার্থক্যকে উপেক্ষা করেন। ধর্ম ও ব্যক্তিগত মূল্যবোধ মানুষের নৈতিক পথনির্দেশনা দেয়, তবে একে অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া বা অপব্যাখ্যা করা অনুচিত।
বাংলাদেশের শিক্ষা প্রণালী এবং আইনের প্রেক্ষাপটে, যদি এই শিক্ষক LGBTQ সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ বজায় রাখেন, তবে তার প্রথম দায়িত্ব উচিত ছিল অন্যায় এবং অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলা, না যে শিক্ষামূলক সম্পদকে ধ্বংস করা। এই ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে, তিনি শিক্ষার একটি অপ্রিয় দিক উন্মোচন করেছেন, যা শিক্ষার উদ্দেশ্য এবং মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে।
বাঙালি জাতির স্বভাব-চরিত্র নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী‘তে লিপিবদ্ধ ভাবনাগুলি আমাদের আত্মসমীক্ষণের আয়না। তিনি বলেছেন, অগণিত গুণাবলী সত্ত্বেও বাঙালি বহুকাল ধরে পরাধীনতা ও অত্যাচার সহ্য করে এসেছে। একজন অশিক্ষিত, কিন্তু চাকচিক্যময় ব্যক্তিত্ব অল্প কিছু আরবি বা ফার্সি জ্ঞানের আড়ালে পীরের আসন দখল করেছে, এবং সরল বাঙালি তার কাছে ধর্মীয় আশীর্বাদ পাওয়ার আশায় অর্থ ঢেলেছে।
সত্যিকারের তথ্য উদ্ঘাটন করলে প্রায়শই দেখা যায় যে, এই ‘পীর‘ ব্যক্তিটি হয়তো কলকাতার এক ফলের দোকানের কর্মী অথবা অপরাধ জগতের কোনো চরিত্র। এইরূপ অন্ধ বিশ্বাস এবং অলৌকিকতায় আস্থা বাঙালির দুর্ভাগ্যের অন্যতম কারণ।
প্রতিটি সমাজে নানান রূপ, নানান বৈশিষ্ট্যের মানুষের সমাবেশ ঘটে। এই বৈচিত্র্য হতে পারে ধর্মে, সংস্কৃতিতে, জেন্ডার পরিচয়ে অথবা মতাদর্শে। এই বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি ও সম্মান সমাজের সভ্যতার লক্ষণ। ব্যক্তিগত বিশ্বাসের প্রতি আস্থা থাকলেও সেই বিশ্বাস যখন অন্যের মৌলিক মর্যাদা ও অধিকারকে লঙ্ঘন করে, তখন সেটি অগ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। এই উপলব্ধি ও সম্মানের পথ ধরেই সমাজ আরও প্রগতিশীল এবং মানবিক হয়ে উঠতে পারে।