লিখেছেন – ফ্লিন রাইডার

আমরা বাংলাদেশের লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর মানুষরা, আমাদের নিজদেশে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, পারিবারিক নানাভাবে মানব অধিকার হতে বঞ্চিত। আর সকল পরিচয়ের মানুষের মত যে মানুষ হিসাবে আমাদের নিজেদের লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ে বেচে থাকার অধিকার আছে, সে সম্পর্কে আমাদের একদম ধারনা নেই। এবং মানব অধিকার নিয়ে অজ্ঞতার জন্য আমরা দিনের পর দিন আমাদের অধিকার হতে বঞ্চিত হচ্ছি, তাই আজকে মানবঅধিকার দিবসে জাতিসংঘ(United nation) আমাদের লিংগ-যৌন বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর মানুষদের মানব অধিকার নিয়ে কি বলেছে ,এবং জাতিসংঘে মানব অধিকারের সুচনা লগ্নের অতীত ইতিহাস হতে বর্তমান সংক্ষেপে ঘুরে আসব এই লিখায়।   

৭২ বছর আগে, ১৯৪৮ সালে ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারন সভাতে(United Nations General Assembly) প্রথমবার বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার নিয়ে ‘সার্বজনীন মানব অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণা’ ( Universal Declaration of Human Rights(UDHR)) গ্রহণ এবং ঘোষণা করা হয়। “সার্বজনীন মানব অধিকার ঘোষণা” ছিল ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী লুপ্ত লীগ অব নেশন্সের হতে নবরূপে সৃষ্ট জাতিসংঘের অন্যতম বৃহৎ অর্জন।তাই এই দিনটি কে সম্মান জানিয়ে, জাতিসংঘের নির্দেশনায় বিশ্বের সকল দেশে প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর মানব অধিকার দিবস পালিত হয়। উপরের নীল হাতের ছবিটি মানব অধিকার দিবসের লোগো। ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা ১৯৩ সদস্য,আমাদের বাংলাদেশও জাতিসংঘের সদস্য।জাতিসংঘের সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে অবস্থিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিজয়ী মিত্রশক্তি, পরবর্তীকালে যাতে যুদ্ধ ও সংঘাত প্রতিরোধ করা যায়— এই উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়। তখনকার বিশ্ব রাজনীতির পরিস্থিতি জাতিসংঘের সাংগঠনিক কাঠামোতে এখনও প্রতিফলিত হচ্ছে। 

এই যে ‘সার্বজনীন মানব অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণা’ ( Universal Declaration of Human Rights(UDHR)) হল ৩০ টি আরটিকেলে সমন্বয়ে গঠিত, এই ৩০টি আরটিকেলে এক জন মানুষের মানব অধিকার সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত এবং বর্ণনা করা আছে।

‘সার্বজনীন মানব অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণা’ ( Universal Declaration of Human Rights(UDHR)) কয়েকটি আরটিকেলের উদাহরন থেকে আমাদের লিংগ-যৌন বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর মানব অধিকারের যোগসুত্র আছে। যেমন আর্টিকেল ১ এ ঘোষণা করা হয়েছে যে, সকল মানুষ সম্মান এবং অধিকারের দিক দিয়ে স্বাধীন ও সমান ভাবে জন্মেছে। আর্টিকেল ২ এ ঘোষণা করা হয়েছে যে- সকল মানুষ সমান অধিকার এবং স্বাধীনতা পাবে। বর্ণ, জাতি ,ভাষা সহ নানান পরিচয়ের সাথে সেক্স এর কারনে বৈষম্য করা যাবে না বলে ঘোষনা করা হয়েছে। এই যে সেক্স শব্দটী উল্লেখ আছে, এর সাথে আমাদের লিংগ-যৌন বৈচিত্র্যময় পরিচয়ের মানুষের মানব অধিকারের প্রথম সুস্পষ্ট সুত্রপাত। আবার আর্টিকেল ১ অনুযায়ী  আমাদের লিংগ-যৌন বৈচিত্র্যময় পরিচয়ের মানুষ সম্মান এবং অধিকারের দিক দিয়ে সকল পরিচয়ের মানুষের মত স্বাধীন ও সমান। আপনি ৩০ টি আর্টিকেল দিয়ে নানান ভাবে আমাদের লিংগ-যৌন বৈচিত্র্যময় পরিচয়ের মানুষের মানব অধিকার রক্ষা করতে পারবেন। এবং প্রতিটী মানুষের এই ৩০ টি আর্টিকেল পড়া উচিত। 

লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর মানুষদেরকে জাতিসংঘের মানবধিকার নিয়ে অফিস অফ হাইকমিশনারের তথ্যসুত্র মতে এলজিবিটিআই টার্ম দ্বারা অভিহিত করা হয়।

উপরোক্ত তথ্যসুত্র মতে, এলজিবিটিআই এর অর্থ কী?

এলজিবিটিআই এর দ্বারা লেসবিয়ান(নারী সমকামী), গে(পুরুষ সমকামী), বাইসেক্সুয়াল/উভকামী, ট্রান্সজেন্ডার(রুপান্তরকামী) এবং ইন্টারসেক্স(আন্তলিংগ) বুঝায়। এই টার্মের ব্যাবহার সাধারণত নির্দেশ করে, যারা একই লিঙ্গের লোকদের প্রতি আকৃষ্ট লোকদের ক্ষেত্রে, জন্মের সময়  দেওয়া লিঙ্গ পরিচয় থেকে আলাদা লিঙ্গ পরিচয়যুক্ত লোকদেরকে , ননবাইনারি পরিচয়ের লোকদের এবং যাদের যৌন বৈশিষ্ট্যগুলি প্রচলিত মহিলা ও পুরুষের সংজ্ঞা অনুসারে মাপসই হয় না, তাদের উল্লেখ করতে ব্যবহৃত হয় । যদিও এই এলজিবিটিআই সংক্ষিপ্ত রূপটি সর্বজনীন স্বীকৃতি পেয়েছে কিন্তু ইহা হিজড়া(hijra), মেটি(meti), লালা(lala), সেকসানা(skesana), মোটসোলে(motsoalle), মিঠলি(mithli), কুচু(kuchu), কাভেইন(kawein), ট্রেভেস্টি(travesty), মুকস(muxé), ফাফাফাইন(fa’afafine), ফাকালিটি( fakaleiti), হামজেনসাগর(hamjensgara) এবং দ্বি-স্পিরিট(Two-Spirit) সহ বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকের বিভিন্ন পরিচয়ের মানুষদের অভিন্নরুপে গণ্য করে।

জাতিসংঘের মানবধিকার নিয়ে অফিস অফ হাইকমিশনারের তথ্যসুত্র মতে, এলজিবিটিআই মানুষ এবং মানবাধিকার সম্পর্কে যা বলা হয়েছে

এলজিবিটিআইয়ের লোকদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করা হলে তা মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে বর্ণিত মানবাধিকার নীতিগুলিকে পতনসাধন করে। তবুও এলজিবিটিআই সম্প্রদায়ের লোকদের বিরুদ্ধে বৈষম্য এবং সহিংসতা খুব সাধারণ বিষয়। হোমোফোবিক, বাইফোবিক এবং ট্রান্সফোবিক মনোভাবগুলি বিশ্বব্যাপী বহু সংস্কৃতিতে এখনো গভীরভাবে যুক্ত।

জাতিসংঘের মানবধিকার নিয়ে অফিস অফ হাইকমিশনারের তথ্যসুত্র মতে, এলজিবিটিআইয়ের লোকেরা কী মানবাধিকার লঙ্ঘনের মুখোমুখি হচ্ছে?

এলজিবিটিআইয়ের লোকেরা বিভিন্ন ধরণের বৈষম্যের মুখোমুখি হন:

  • শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে বৈষম্য করা
  • তাদের নিজের পরিবার দ্বারা দুর্ব্যবহার এবং অস্বীকার করা
  • শারীরিক আক্রমণ এবং চরম সহিংসতার জন্য লক্ষ্যবস্তু করা – মারধর, যৌন নিপীড়ন, নির্যাতন ও হত্যা করা। 

জাতিসংঘের মানবধিকার নিয়ে অফিস অফ হাইকমিশনারের তথ্যসুত্র মতে,এলজিবিটিআইয়ের লোকদের সুরক্ষার জন্য রাজ্যের মূল আইনী বাধ্যবাধকতা

এলজিবিটিআই মানুষদের সহিংসতা ও বৈষম্য থেকে রক্ষা করার জন্য নতুন করে মানবাধিকার আইন বা মানের প্রয়োজন হয় না। এলজিবিটিআইয়ের মানুষদের মানবাধিকার রক্ষার জন্য আইনত রাষ্ট্রের আইন প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে এটি সুপ্রতিষ্ঠিত। এটি মানবাধিকার এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিগুলির সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের(UDHR) ভিত্তিতে তৈরি।

এলজিবিটি লোকদের মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলির মূল আইনী বাধ্যবাধকতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:

  • স্বতন্ত্র ব্যক্তিগণকে হোমোফোবিক এবং ট্রান্সফোবিক সহিংসতা থেকে রক্ষা করুন
  • নির্যাতন ও নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অবমাননাকর আচরণ প্রতিরোধ করুন
  • সমলিঙ্গের মানুষদের যৌন সম্পর্ক এবং ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের অপরাধমূলক করে তোলা আইন বাতিল করা
  • যৌন দৃষ্টিভঙ্গি এবং লিঙ্গ পরিচয়ের ভিত্তিতে বৈষম্য নিষিদ্ধ করা
  • এলজিবিটিআইয়ের মানুষদের জন্য মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমিতি এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশ নিরাপত্তা দেয়া

তথ্য সুত্র-

১। Office of the United Nations High Commissioner for Human Rights (ohchr) এর এলজিবিটীকিউ সংক্রান্ত লিংক- https://www.ohchr.org/EN/Issues/LGBTI/Pages/index.aspx

২। ‘সার্বজনীন মানব অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণা’ ( Universal Declaration of Human Rights(UDHR)) এর লিংক- https://www.un.org/en/universal-declaration-human-rights/

উপরের নীল হাতের ছবিটি মানব অধিকার দিবসের লোগো।