লেখক : অশ্বিনী

বিলুপ্তি ঠেকাতে দেশি সবজির বীজ সংরক্ষণ করে চলেছেন সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষাণী অল্পনা রানী মিস্ত্রি৷ বিবিসি নিউজে প্রচারিত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন ‘সব দেশী বীজ তো হারিয়ে যাচ্ছে, দেশি বীজ না রাখায় আমরা কোম্পানীর কাছে জিম্মি হয়ে গেছি। প্রতি বছর আমরা কোম্পানির কাছে যাচ্ছি, বীজ ফুটলো না, দ্বিতীয়বার আবার কোম্পানির কাছে যাচ্ছি।’ 

ইকোফেমিনিজম কৃষকের স্বনির্ভর হওয়ার কথা বলে। আধুনিক কালে পুঁজিবাদী আগ্রাসনে কৃষক দিন দিন কোম্পানিমুখী হতে বাধ্য হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর কৃষিকাজ এবং হাইব্রিড ফসল যেভাবে একজন নারীর কর্মসংস্থানকে গ্রাস করছে, ঠিক সেভাবেই প্রকৃতিকেও হুমকির মুখে ফেলছে। নারীর প্রতি সহিংসতা আর প্রকৃতির প্রতি বিরূপ আচরণ যেন একই সুতায় গাঁথা। উন্নত বিশ্বের পুঁজির যোগান দিয়ে চলেছে এই তৃতীয় বিশ্ব বা শ্রমজীবি মানুষেরা। তৃতীয় বিশ্বের শ্রম, প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করে গড়ে উঠেছে এককেন্দ্রিক এবং উন্নত বিশ্বব্যবস্থা।

ইকোফেমিনিজম বা পরিবেশবাদ শব্দটি সর্বপ্রথম ‘ফ্রোঁসোয়া দা ওবোঁন’ ব্যবহার করেন তার ‘লে ফপমিনিজম উলমো’ বইতে। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে দুটি আন্দোলন ভীষণ ভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। একটি হচ্ছে নারীবাদীআন্দোলন অপরটি হচ্ছে পরিবেশবাদী আন্দোলন। এই সময় কিছু নারীবাদী বলতে শুরু করলো যে আন্দোলনের লক্ষ্য ও গতিপথ একইদিকে। এই দুটি আন্দোলনই পুরুষতন্ত্রের প্রভাব থেকে মুক্ত। ইকোফেমিনিজম সাধারণ ভাবেই নারীবাদের একটি অন্যতম স্রোত। র‍্যাডিকাল নারীবাদ, মার্কসবাদী নারীবাদ, লিবারেল নারীবাদ এবং সাংস্কৃতিক নারীবাদের মতোই একটি ধারা। ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী নারীবাদকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছে। তবে ইকোফেমিনিজম এমন এক নারীবাদ, যা শুধুমাত্র কর্মজীবী নারী কিংবা শুধুমাত্র শহুরে নারীর কথা বলে না, এটি সামগ্রিক ভাবে সকল নারীদের কথাই বলে; শ্রমিক, কৃষক এমনকি কুইয়্যার মানুষদের অধিকার নিয়েও এই নারীবাদ কথা বলে। আধুনিককালে সরকারি বেসরকারি নানা ধরনের উদ্যোগ থাকা স্বত্তেও নারীদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে না, পরিবেশ নারীবাদীরা মনে করে ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণ ঠেকাতে না পারলে এটি কখনো সম্ভব নয়। তারা মনে করে নারীর জন্য র্যাডিক্যাল নারীবাদ এবং অন্যান্য নারীবাদ গুলো পিতৃতান্ত্রিক সমাজ দ্বারা প্রভাবিত। তাদের চিন্তাগুলোও ঠিক পুরুষতন্ত্রের মতো কাজ করছে। 

ইকোফেমিনিস্টদের মতে, প্রতিটা মানুষের একাধিক আলাদা আলাদা আইডিন্টিটি আছে। সেটা হতে পারে লৈঙ্গিক, জেন্ডার ভিত্তিক, সামাজিক। মানবিক মূল্যবোধ লিঙ্গ -নিরপেক্ষ হওয়া উচিত। সেখানে নারী,পুরুষ, কুইয়্যার ভেদাভেদ করা উচিত না। 

পরিবেশ নারীবাদ হচ্ছে একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। যেখানে নেতৃত্ব দিচ্ছে বিভিন্ন স্তরের নারীবাদী এনং পরিবেশবাদীরা। পরিবেশ নারীবাদিরা মনে করে, নারীর প্রতি সহিংসতার সাথে প্রকৃতি ধ্বংসের একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। নারী দেহের প্রতি আধিপত্য এবং প্রকৃতির প্রতি আধিপত্য একই সূত্রে বাঁধা। জমির প্রতি যেমন পুরুষের মালিকানা তেমনি নারীর প্রতিও পুরুষের মালিকানা থাকে। জমি চাষে জন্য যেমন কর্ষণ করা হয়, নারীকেও তেমন ধর্ষণ করে। নারীকে শস্য ক্ষেতের সাথে তুলনা করা হয়। নারী কেবলই ভোগ্য বস্তু এবং সন্তান বা শস্য উৎপাদনের মেশিন। যেভাবে মানুষের প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে, বন ধ্বংস করছে,জীব বৈচিত্র্য ধ্বংস করছে। নারীকে যেভাবে প্রকৃতির সাথে তুলনা করে আবার প্রকৃতিকে নারীর সাথে তুলনা করে কার্যত একই ভাবে প্রকৃতি এবং নারীকে নির্যাতন করছে। তেমনি ভাবে মানবসমাজেও পুরুষতন্ত্র এবং পুঁজিবাদ  বর্ণ বিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ, নারীর প্রতি নীপিড়ন সব কিছুই নারীর প্রতি আত্যাচার ও নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংসের ভিতরই আছে।

পৃথিবীতে যুদ্ধ, সম্রাজ্য, বিজ্ঞান, শিল্পের ইতিহাস হচ্ছে পুুরুষের ইতিহাস। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নারীর অবদানকে অস্বিকার করে এসেছে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। ইকোফেমিনিস্টরা মনে করে পৃথিবীর সকল সভ্যতা,সংস্কৃতি নির্মানে নারীর ভুমিকাকে কেবলই উপেক্ষা করা হয়েছে। সভ্যতার উন্নতির দোহাই দিয়ে একের পর এক  পরিবেশ ধ্বংস করাটা মোটেও যৌক্তিক নয়। মাতৃ প্রধান বা পরিবেশ কেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পরিবেশ যেমন সুরক্ষিত ছিলো, তেমনি নারীরা নিজেই সাবলম্বী ছিলো। তাই পরিবেশকে বাঁচিয়ে, নারীকে সমান অধিকার দিলেই এই পৃথিবী সমূহ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে।

তথ্যসূত্র :

১) https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ecofeminism

২) https://www.britannica.com/topic/ecofeminism

৩) বই : ইকোফেমিনিজম নারীবাদ ও তৃতীয় দুনিয়া প্রান্তিক নারী

প্রথম প্রকাশঃ ঠাহর (প্রথম সংখ্যা)