লেখক : অরণ্য রাত্রি

বডি শেমিং এখন খুব পরিচিত একটি শব্দ । অনেক জায়গাতেই এই ব্যাপারে আজকাল আলোচনা করা হচ্ছে। এবং দুর্ভাগ্যবশতঃ আমাদের দেশেও বডিশেমিং ব্যাপক হারে করা হয়। বডি শেমিং আসলে কি?

বডি শেমিং হল মানুষের শারীরিক অবয়ব নিয়ে অপমানজনক মন্তব্য করা বা এমন কিছু করা যা তার জন্য মানহানিকর।

এক সময় মনে করা হত, বডি শেমিং শুধু মাত্র মেয়েদের করা হয়। কিন্তু সময় বদলেছে। মানুষের ধ্যান ধারণা, চিন্তা , ভাবনাও বদলেছে। সমাজের নিয়ম, কানুন, রীতি নীতিতে পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তন যে সব সময় ভাল কিছু নিয়ে আসে তা নয়। যেমন এখন মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেদেরকেও বডি শেমিং করা হয়।

একুয়াম্যান সিনেমাটি অনেকেরই দেখা এবং এই সিনেমার নায়ক জেসন মোময়া কেও হয়তো অনেকেই চিনে থাকবেন। অনেকরই হয়তো ক্রাশ তিনি। সম্প্রতি তিনি ভ্যাকেশনে একটি শার্ট ছাড়া খালি গায়ের একটি ছবি তুলেছেন এবং সোশ্যাল মিডিয়া তে পোস্ট করেছিলেন। এবং তাতে দেখা যায় তার পেটে সামান্য মেদ জমেছে। আর যায় কোথায় । সারা সোশ্যাল মিডিয়া এই ছবি দেখে আলোচনায় মগ্ন। নানা তির্যক মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে তার প্রতি। এটা বডি শেমিং এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ

আমাদের দেশে প্রায় কিছু ত্বক ফর্সা করার ক্রিমের এড হয়। আজকাল ছেলেদের জন্য আলাদা করে ত্বক ফর্সা করার ক্রিম রয়েছে। আসলেই কি এই ক্রিম গুলো ত্বক ফর্সা করে? সেই বিতর্কে না যাই। বিজ্ঞাপন গুলোতে বলা হয়, এই ক্রিম গুলো ব্যবহার করলে ছেলেরা অল্প কিছুদিনের মাঝেই ফর্সা এবং হ্যান্ডসাম হয়ে যাবে। তার মানে কি দাঁড়ায় হ্যান্ডসাম হতে হলে ফর্সা হতে হবে? যাদের ত্বক শ্যাম বা কৃষ্ণ বর্ণের তারা কি কখনো হ্যান্ডসাম হতে পারে না? নাকি আগে তাদের ক্রিম মেখে ফর্সা হতে হবে? তাহলে এই এড কি আমাদের মাথায় এই চিন্তা ঢুকিয়ে দিতে চাচ্ছে না যে হ্যান্ডসাম মানেই ফর্সা?

আবার কিছু কিছু বিজ্ঞাপন আছে যেমন হেয়ার ওয়েভিং বা বন্ডিং করে । তারা বলে হেয়ার বন্ডিং করে তারা যাদের মাথায় টাক রয়েছে তাদের চির সবুজ করে তুলে। কেন যাদের চুল নেই তারা কি সব বুড়ো হয়ে গিয়েছে। মনের দিক থেকে তরুণ থাকতে পারলেই হল।

বিভিন্ন ধরণের ফ্যাশন ম্যাগাজিন গুলোতে পুরুষের সৌন্দর্য্য চর্চায় আজকাল নতুন করে অনেক কিছু যোগ করা হচ্ছে। যেমন মেকাপ, ওয়াক্সিং , প্রোটিন শেক, লম্বা হবার যন্ত্র, স্বাস্থ্য ভাল করার ওষুধ কিংবা এক সপ্তাহে পাঁচ কেজি ওজন কমিয়ে দিবে এমন ওষুধ ইত্যাদি। এসব পণ্যগুলো এইভাবে প্রচারণা পাচ্ছে। আর এসকল পণ্য বিক্রি করার জন্য বডি শেমিং এর আশ্রয় নিচ্ছে কেউ কেউ।

নব্বই দশকে পুরুষের সৌন্দর্য্য বলতে আমরা বুঝতাম চওড়া বুক, আর শক্ত মাংস পেশী। কিন্তু ধারণা এখন বদলে গিয়েছে। এখন সৌন্দর্য্য মেদহীন শরীর। জিম করা , শেপ আনা বডি। জিম না করলে পুরুষালী ভাব পুরোপুরি আসে না এরকম একটা ধারণা এখন তৈরি হয়েছে। তাহলে যারা জিম করে না তারা কি পুরুষালী নয় বা যারা জিম করে তাদের থেকে কম পুরুষালী?

এই সকল চিন্তা কিন্তু ছোট বেলা থেকেই আমাদের মনে সমাজ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। কি করলে মানুষ সুন্দর হবে তার বৈশিষ্ট্য আগে থেকেই সমাজ ঠিক করে রেখেছে। এগুলো হলো সোসাইট্যাল বডি শেমিং।

স্কুলে থাকতে কোন ছেলের যদি ওজন বেশি থাকে তাহলে আর যায় কোথায়? সারা টা স্কুল লাইফ তার বডি শেমিং এর শিকার হতে হয়। তার নাম পর্যন্ত বদলে যায়। তার নামের পরিবর্তে তাকে ডাকা হয় ভোঁটকা , মটকা ,মটু, মোটা । শুনতে হয় নানা রকম তির্যক মক্তব্য। যেমন , তুই “এই বেঞ্চে বসলে বেঞ্চ তো ভেঙে যাবে”। আবার অত্যাধিক খাটো ছেলে কেও শুনতে নানা কথা। তাকে ডাকা হয় নাটু, বাটু, খাটু ইত্যাদি নামে। যেন খাটো হওয়াটা তার আজন্ম পাপ।আর একটি বাচ্চা যখন স্কুলে এ ধরনের বুলিং এর শিকার হয় তার ভিতর যে ক্ষত তৈরি হয় তা আজীবন থেকে যায়। যখন বাচ্চাটি অনুভব করে যে তার শারীরিক অবয়বের জন্য সে অন্যদের থেকে আলাদা তখন সে বিশ্বাস করে সে আসলেই ভালবাসার যোগ্য নয়। তার জীবনের ফোকাসই হয়ে যায় শরীরে পরিবর্তন আনা। কিন্তু তার থেকে বেশি যে সমস্যা হয় তা হল সে নিজেকে মূল্যহীন মনে করে।

এবার আসুন পরিনত বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে কি হয়। পরিণত বয়সে যেয়ে যে তারা বডি শেমিং থেকে বেঁচে যায় তা নয়। যেমন একজন খুব শুকনো ছেলে যার কোমর ২৮ ইঞ্চি সে প্যান্ট কিনতে গেল। কিছুক্ষণ দোকানদার চুপ থেকে হেসে বলল , “ আপনার সাইজের প্যান্ট ভাই বাচ্চাদের দোকানে পাওয়া যাবে” । এই বলে কিছুক্ষন হাসলো। আবার যার কোমর ৩৮ ইঞ্চি তাকে হয়তো বলে, “ভাই আপনি অর্ডার দিয়ে প্যান্ট বানায় নেন “।এবং হাসলো। এই কাজ গুলো দোকানদার বা সেলসম্যানটি না করলেও পারতো। তার দোকানে এই সাইজের প্যান্ট নাই এটা বলে দিলেই চলতো। কিন্তু সেই যে সমাজ আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বডি শেমিং ঢুকিয়ে দিয়েছে।

বডি শেমিং এর ভয়ে অনেকেই আজকাল অনেক ভাল লাগার কাজ করতে ভয় পায়। যেমন সুইমিং পুলে সাঁতার কাটা। সেখানে তো খালি গায়ে নামতে হবে। আর সবার সামনে মেদ ওয়ালা শরীর দেখাতে লজ্জা পায় অনেকেই। আবার সেক্স পার্টনার যোগাড় করতেও ভয় পায় অনেকেই।কেউ যদি পছন্দ না করে।

আজকাল মেয়েরাও ছেলেদের কে বডিশেমিং করে থাকে। কোন একটি ছেলে যদি তার চোখে অসুন্দর হয় এবং ছেলে টা যদি তাকে প্রপোজ করে তাহলে অনেকেই বলে ফেলে , “আয়নায় নিজের মুখটি দেখেছো?” কেন তাকে না করার জন্য আর কোন কিছু কি বলা যেত না?

হ্যাঁ এবার আসি আমাদের কমিউনিটি তে। আমাদের কমিউনিটি তে বডি শেমিং অনেক বেশি হয়। এমনও হয় প্রথম বার দেখা করতে গিয়েছে কারো সাথে।অন্যজন দূর থেকেই দেখে ফোন করে বলেছে , “আপনার সাথে আমি দেখা করবো না “। অথবা মোবাইল অফ করে দিয়েছে।কিংবা গ্রাইন্ডারে ছবি দেখেই ব্লক করে দিয়েছে। একটা মানুষের বাহ্যিক অবয়বের জন্য এইভাবে অপমান করা কি ঠিক ? তার অবয়ব বা চেহারা পছন্দ না হতেই পারে। কিন্তু সেটা ভদ্র ভাবে বুঝিয়ে বন্ধু সুলভ আচরণ করে বলাটাই সমীচীন। আবার কেউ কেউ তো মুখের উপর বলেই দেয়, “ তুমি দেখতে ভাল না”। কিন্তু তুমি কে সৌন্দর্য্য বিচার করার। সৌন্দর্য্য আপেক্ষিক। কারো কাছে কেউ সুন্দর আবার কারো কাছে সেই একই ব্যক্তি অসুন্দর। আমার মতে ব্যক্তিত্ব, জ্ঞান , এগুলোও সৌন্দর্য্যের অংশ।

যেসব বিষয় নিয়ে ছেলেরা সাধারনত বডি শেমিং এর শিকার হয় তা হল

– উচ্চতা

– ওজন

– চুলের ঘনত্ব

– ত্বকের রঙ

– শরীরের পশম

– দাঁড়ি না উঠা

– শরীরের ব্যক্তিগত অংশের মাপ

লজ্জা বা গ্লানি বলা হয় মানুষের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক আবেগ। গ্লানি থাকলে মানুষ মনে করে তার নিজের মধ্যে কোন সমস্যা অবশ্যই রয়েছে।আর এই ধারণা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে থাকে। নিজেকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।

বডিশেমিং এক কারণে একজন মানুষের যে পরিণতি গুলো হতে পারে:

– বিষণ্ণতা

– একাকীত্ব

– হতাশ

– আত্মবিশ্বাস দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া।

– মাদক নেয়া

– ইটিং ডিসঅর্ডার ( এক ধরণের মানসিক অসুখ )

– আত্মহত্যার চিন্তা

– আত্মহত্যা করা

সুতরাং দেখা যাচ্ছে বডি শেমিং আমাদের শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতি করে থাকে। এ ক্ষেত্রে বলে নেয়া ভাল যে ওজন কমানো বা বাড়ানো কোন কোন ক্ষেত্রে বডি শেমিং এর পর্যায় পড়ে না। যেমন অত্যাধিক ওজন থেকে নানাবিধ অসুখ হতে পারে। সেই সব ক্ষেত্রে একজন চিকিৎসক বা শুভাকাঙ্ক্ষী যখন পরামর্শ দেন কোন রকম তির্যক মন্তব্য না করে সেটা কিন্তু বডি শেমিং নয়।

পরিসংখ্যান

ইউ কে তে মেন্টাল হেলথ ফাউন্ডেশনের একটা গবেষণায় দেখা যায়

১৩% পরিণত বয়স্ক মানুষের শুধু মাত্র বডি ইমেজের কারণে আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসে

২১% পরিণত বয়স্ক মানুষ শুধু মাত্র বিজ্ঞাপন দেখে নিজের বডি ইমেজ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পরে

২২% পরিনত বয়স্ক মানুষ এবং ৪০% কিশোর সোশ্যাল মিডিয়ার কারনে নিজের বডি ইমেজ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগে।

বডি শেমিং দূর করতে কি পদক্ষেপ নিতে পারি:

প্রথমেই মনে রাখতে হবে কেউ চাইলেই সব কিছু পরিবর্তন করতে পারে না। যেমন আমাদের চুলের রঙ , ত্বকের রঙ, গায়ের পশম, চুলের ঘনত্ব। কেউ কেউ জন্মগত ভাবে ওজন বেশি বা কম থাকে। সুতরাং নিজের শারীরিক যে অবয়ব বা চেহারা তা গ্রহন করে নিতে হবে। এই গ্রহণযোগ্যতা আত্মসম্মান বাড়ায়। আর যখন কেউ নিজেদের মূল্য দিতে শিখবে , নিজেরা যেমন তেমন ভাবেই নিজেদের গ্রহণ করতে শিখবে, যে যাই বলুক না কেন তখন কিন্তু তারা যে কোন চ্যালেঞ্জ দৃঢ় ভাবে মোকাবেলা করতে পারবে।

নিজের যে ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি সুন্দর বা প্রশংসাযোগ্য মনে হয় যেমন কেউ কেউ মনে করে তার নিজের হাসি সুন্দর , কেউ মনে করে তার নিজের কথা বলার ধরণ সুন্দর , সেই ব্যাপারটা কে হাইলাইট করতে হবে। আর মনে করতে হবে যে সবার মত তার নিজেরও কিছু প্রশংসাযোগ্য ব্যাপার রয়েছে।

একটা বাস্তব এবং ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদি ওজন কমানো বা বাড়ানো নিজের জন্য মাথাব্যাথার কারণ হয় তাহলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কি করা যায়। অনেক উপায় আছে নিজে এই সিদ্ধান্ত কে পূর্ণতা দেয়ার। কিন্তু শুধু মাত্র বডি শেমিং এর উপর ভিত্তি করে এই ধরণের সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক । পাছে লোকে কিছু বলে… এই ব্যাপার টা আমাদের মাঝে মনে হয় রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে আছে। কিন্তু এই পাছে লোক গুলো কারা সেটাও চিন্তা করে দেখতে হবে। আর তাদের কথার কতখানি গুরুত্ব দেয়া উচিৎ তাও ভাবতে হবে। যারা বডিং শেমিং করে তাদের সংস্পর্শ ত্যাগ করাই ভাল। তারা কখনো ভাল বন্ধু হতে পারে না। বরং যারা ইতিবাচক মানসিকতার অধিকারি তাদের সংস্পর্শে আসলে বরং বডি শেমিং এর মত নেতিবাচক ব্যাপার থেকে দূরে থাকা যাবে।

নিজের সীমাবদ্ধতা কে নিজের শক্তি তে পরিণত করতে হবে। মনে রাখতে হবে সব কিছুর মাঝে ভাল কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হবে। যেমন কারো কারো গলার স্বর ভারী হয় না। সেটা কে কেউ কেউ মেয়েলি মনে করবে আবার কেউ কেউ বিনয়ী মনে করবে। এখন নিজের সিদ্ধান্ত নিতে হবে নিজে কার মনে করা কথা টা কে বেছে নিবে।

মোটিভেশন বাড়ায় ,ইতিবাচক মানসিকতা তৈরি করে এমন বই এবং ভিডিও দেখা।

সোশ্যাল মিডিয়া তে আজকাল বডিশেমিং করা হয় । এমন কেউ বন্ধু তালিকায় থাকলে তাকে আনফ্রেন্ড বা আনফলো করে দেয়া ভাল।

নিজের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য্য কে তারিফ করতে শিখতে হবে। অবশ্যই নিজেকে একজন সুন্দর মানুষ হিসেবে মনে করতে হবে। নিজের উপর বিশ্বাস আনতে হবে।

প্রথম প্রকাশঃ ঠাহর (প্রথম সংখ্যা)