লেখক – ঙা

আমি ঙা ৷ আমি গারো এবং কুইয়ার কমিউনিটির একজন সমকামী পুরুষ ৷ আজ কিছু কথা শেয়ার করব ৷ কথাগুলো আমার গারো হিসেবে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় সেসব নিয়ে ৷ তো একেবারে প্রথম থেকেই শুরু করি ৷

আমি গারো হলেও বড় হয়েছি শহরে ৷ কোনো নির্দিষ্ট শহর না ৷ বাবা পুলিশ ছিলেন ৷ কিছুদিন পরপরই বদলি হতেন তিনি ৷ আমাকে গারো ভাষা (মান্দি খু.সিগ ) না শিখিয়ে বাংলা ভাষা শেখানো হয় ঠিক এ কারণেই ৷ যেন আমি সমবয়সী সবার সাথে খেলাধুলা,কথা-বার্তা বলতে পারি ৷ ভাব প্রকাশে যেন সমস্যা না হয় ৷ বাবা-মার থেকে ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি আমরা দুই ভাই নাকি খুব সুন্দর ছিলাম ৷ লোকে নাকি আমাদের অবাক হয়ে দেখত খুব সুন্দর ছিলাম বলে ৷

প্রথম ঘটনা বলি ৷ তখন বাবার বদলি মানিকগঞ্জে হওয়ায় আমরাও মানিকগঞ্জেই ছিলাম ৷ তখন বয়স কত হবে আর ? বয়স তিন-চার হবে হয়তো ৷ বাড়ির সামনে বালির স্তুপে একদিন খেলছিলাম ৷ তখন আমার সমবয়সী একটা ছেলে আমাকে চাকমা-চাকমা বলে খেপাচ্ছিল ৷ এটাই আমার জীবনে প্রথম ছিল (আমার যতটুকু মনে আছে)৷ সেদিন ওই ছেলেটার দিকে রাগবশত বালি ছুড়ে দিয়েছিলাম কিনা মনে নেই (হয়তো ছুড়ে দিয়েছিলাম ) তবে ওই খেপানোটা আমার জন্য সুখপ্রদ ছিল না এবং এটা আমার মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল ৷ চাকমা শব্দটা নতুন হওয়ায় মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছিল ৷ অনেকদিন মনের মধ্যে এই শব্দটার অর্থ জানার অনেক ইচ্ছা মনের মধ্যে ছিল ৷

পরে আমরা গ্রামে চলে এসেছি ৷ গ্রামে ছিল পাঁচটা গারো পরিবার ৷ আমরা ওই গ্রামেরই পশ্চিমে থাকতাম ৷ পূর্বে থাকত ৫০+ গারো পরিবার ৷ আমরা একই সমাজে ছিলাম ৷ গ্রামে আসার পরই আমি জানতে পারি আমি গারো , আমি খ্রিষ্টান ৷ আমি তখন এত ছোট্ট ছিলাম যে আমি ওইসব শব্দের অর্থই বুঝতাম না ৷ আর সাথে গ্রামে এসে গারো ভাষা শুনে অনেক অবাক হয়ে গেছিলাম ৷ গ্রামে আমাকে গারো বলে অনেক খেপানো হতো ৷ ময়মনসিংহ সীমান্তে একটা ছড়া আছে গারোদের খেপানোর জন্য ৷ ছড়াটা হলো –

গারো-গারো এগারো ,
মিইল্লা মারাম পাগারো ! ( তুলে ফেলে দেব পুকুরে )
পাগারের পানি কালা , (পুকুরের পানি কালো)
গারো আমার শালা !

এটা গারো অধ্যুষিত এলাকায় থাকা বাঙালিদের জিজ্ঞেস করেই এই ছড়াটার জনপ্রিয়তা সম্পর্কে জানতে পারবেন ৷

গারোদের সম্পর্কে আমি আরো জানতে পেরেছি বাঙালিদের থেকেই ৷ গারোদের সন্তান জন্ম হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই নাকি তাদের নাকটা চেপে ধরে চাপ দিয়ে চ্যাপটা করে দেওয়া হয় ৷ আর যদি দুই দিক থেকে হাত-পা ধরে টেনে দেওয়া হয় তাহলে নাকি গারোরা লম্বা হয় ৷ আর যদি এর উল্টোটা করা হয় তাহলে নাকি গারোরা খাটো হয় ৷ এই কথাগুলোর সবগুলোই মিথ্যা ৷

আরেকটা কাহিনী শুনেছিলাম আমি আমার এক বাঙালি বন্ধু কাদিরের কাছ থেকে ৷ কাহিনীটা বলছি ৷ একদিন স্রষ্টা(আল্লাহ্ ) নাকি বিশ্বের সব জাতিকে ডাকলেন ৷ তাদের কয়েকটা জিনিসের মধ্যে কিছু জিনিস চাইতে বললেন ৷ ইংরেজরা নাকি টাকা চেয়েছিল , মুসলমানরা নাকি জান্নাত চেয়েছিল আর আমরা গারোরা নাকি সৌন্দর্য্য চেয়েছিলাম (শারীরিক সৌন্দর্য ) ৷ যদিও আমি এখন বুঝি যে একটা হলো ধর্মীয় জাতি আর আরেকটা হলো জিনগত জাতি বা রক্তের সম্পর্কের জাতি ৷ তো , এটা বলে সে আমাকে অনেক কটুক্তি করতো ৷

আরেকটা বিষয় হলো খাদ্যাভ্যাস নিয়ে ৷ তো , বাঙালিদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত আছে যে গারোরা নাকি পায়খানা আর লোহা ছাড়া পৃথিবীর সবকিছু খায় ৷ গারোরা সাপ খায় , ব্যাঙ খায় ৷ আরো কুচে,শামুক,ঝিনুক,বাঁশ,ঘাস ফড়িং, বেজি,কাকড়া,
কুকুর,শেয়াল,বানর,তেলাপোকা,কচ্ছপ,তিত বেগুন ,বাদুড় খায় ৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টা নিয়ে তিরস্কারের শিকার হতাম সেটা হলো শুকর নিয়ে ৷ যেহেতু মুসলমানদের জন্য শুকর খাওয়া হারাম সেজন্য আমাকে এটার জন্য প্রচুর কথা শুনতে হতো ৷ এর মধ্যে কিছু কথা সত্য ৷ আর কিছু কথা মিথ্যা ৷

আমার আরেকটা ঘটনা মনে আছে যখন আমাকে এবং আমার পাশের বাড়ির এক ছেলেকে (আমরা আত্মীয় এবং বন্ধু দুটাই ছিলাম ) ক্লাস থ্রীতে পড়ার সময় একজন পার্টটাইম শিক্ষিকা গারো ভাষা অনুবাদ করতে বলেছিল ৷ কিছু কথা মনে আছে ৷ যেমন ম্যাডাম বলেছিল আমরা কী দিয়ে ভাত খেয়েছি ৷ আমরা দুজনেই বলেছিলাম ডিম দিয়ে ৷ আর কিছু মনে করতে পারছি না আমি ৷ এই অভিজ্ঞতা আমাদের দুজনের জন্যেই খুবই খারাপ ছিল ৷ কারণ তখন ক্লাসের সবাই আমাদের কথা শুনে হাসছিল ৷ কয়েকজন ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপও করছিল ৷ আমারা দুজনই লজ্জা পেয়েছিলাম এবং আমাদের মন খারাপ হয়ে গেছিল এমন অপমানে ৷

আরেকটা ঘটনা হলো যীশু খ্রিষ্টের মৃত্যুর কাহিনী নিয়ে ৷ খ্রিষ্টধর্ম ও ইসলাম ধর্মে এই বিষয়টা নিয়ে প্রচুর দ্বন্দ্ব আছে ৷ ইসলাম ধর্ম বলে ঈসা নবীকে (যীশু খ্রিষ্ট ) সরাসরি আসমানে তুলে নেওয়া হয়েছিল ৷ কিন্তু খ্রিষ্টধর্ম বলে , যীশু মানুষের পাপের জন্য মৃত্যুবরণ করেছিল ৷ পরে তিনদিন পর ( বি.দ্র.— তখন বারো ঘণ্টাকে একদিন ধরা হতো ৷ মানে ১২x৩=৩৬ ঘণ্টা ) পুনরুত্থান মানে পুনর্জীবিত হয়েছিলেন ৷ এটা ছাড়াও আছে খ্রিষ্টানদের যীশু খ্রিষ্টকে ঈশ্বরের পুত্র বলা নিয়ে বা মনে করা নিয়ে ৷ অথবা পবিত্র ত্রিত্বে (পিতা,পুত্র,পবিত্র আত্মা ) বিশ্বাস করা নিয়ে ৷ আমাদের মুসলমানি করানো হয় কিনা , কেন করা হয় না , করালে কী হবে,আমি কেন করি না এসব নানা প্রশ্ন করা হতো সমবয়সীদের থেকে ৷ তো , এসবের জন্য সমবয়সীদের থেকে শুনতে হতো আমরা নাকি পাপী , ভুল পথে আছি , একমাত্র স্থান জাহান্নাম ৷ এখনো সময় আছে সঠিক পথে আসার জন্য ৷ এটার জন্য শিক্ষার্থী আর শিক্ষক এই দুই পক্ষ থেকেই সবসময় আক্রমণ করা হতো৷

আরেকটা হলো গারোদের মদ নিয়ে ৷ তো , এই মদ নিয়ে এত অপমান করা হয়েছে যেটা বলার মতো না ৷ উল্লেখ্য , এটা গারোদের সংস্কৃতির একটা অংশ ৷ ঐতিহ্যভাবে গারোরা মদ খায় ৷ গারো অধ্যুষিত অঞ্চলের বাঙালিরাও এ মদ খায় ৷

ভাষা নিয়ে আরো কিছু কথা বলার আছে ৷ গারো ভাষা হলো সিনো-টিবেটান (চীনা-তিব্বতী) ভাষা পরিবারের ৷ আর বাংলা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের ৷ তো , এই দুটো ভাষার মানুষদের উচ্চারণে কতটুকু পার্থক্য থাকতে পারে সেটা নিশ্চয় অনুমান করতে পারছেন ? গারো ভাষায় ড,ঢ,ধ,ঘ,ঝ,ভ,ঝ ইত্যাদি ধ্বনি নেই ৷ অনেক গারোই (তবে বর্তমানে অবশ্য অধিকাংশ গারো বাংলা ভালোভাবেই বলতে পারে ) এসবের উচ্চারণ করতে পারে না ৷ গারোরা “দুইডা”কে (দুইটা) বলে দুইদা ৷ আবার অনেক গারোরা বাক্যের শেষে থাক্ -সে (থাকা বা থেকেছে ) বলে থাকে ৷ যেমন “খাইছে”কে(খেয়েছে) গারোরা বলে খায়া থাকসে ৷ এসবের জন্য বাঙালিদের থেকে অপমানিত হতে হয় ৷ আমাদের , আমাদের মতো কথা বলে ব্যাঙ্গ করা হয় ৷

আমি আগে থেকেই বলেছি আমি ছোটবেলা থেকেই বাংলা পারি ৷ তো আমার বাংলা পড়তে, লিখতে,বলতে,বাঙালিদের সাথে চলতে কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল না ৷ আমার বিপরীত মানুষও কিন্তু আছে ৷ একটা মেয়ের কথা বলছি ৷ ও ছিল আমার পাশের গ্রামের ৷মেয়েটা আমার থেকে কয়েক ক্লাস বড় ছিল ৷ বাংলা বলতে তো পারতই না , বাংলা বুঝতেও পারত না ৷ এটার জন্য যে তাকে কত কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে সেটা আমি নিজ চোখে দেখেছি ৷ বাংলা ভাষা না পারায় তার মধ্যে সবসময়ই ভয় থাকত ৷ তার মা সারাদিন স্কুলে বসে থাকত তার জন্য ৷ তাকেও কিন্তু ক্লাসে গারো হওয়ার জন্য,বাংলা না পারার জন্য অনেক ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপের স্বীকার হতে হয়েছে ৷ আমার আরেক বন্ধুর কথা বলি ৷ সে আমাদের স্কুলের এক বন্ধুর নাম উচ্চারণ করতে পারত না ৷ সে নাজমুল নামটাকে
” নাস্ -মুল্ ” অথবা অনেকটা “নাস্ -স্মুল্ “এর মতো উচ্চারণ করত ৷ তাকে নিয়ে হাসাহাসি হতো প্রচুর এজন্য ৷বাংলাদেশে গারো ভাষা আজ বিলুপ্তির পথে ৷ যদি পারি তাহলে কিছু একটা করার চেষ্টা করব ৷ গণনা(১………..) , সপ্তাহের নাম,সবজির নাম,মাসের নাম সবকিছু হারিয়ে গেছে ৷

এবার কাপড় নিয়ে কথা বলব ৷ গারোরা আগে অনেক ছোট কাপড় পড়ত ৷ একটা কাপড় হলো গান্দো ৷ এটা পুরুষরা পড়ত ৷ এটা অনেকটাই জাঙ্গিয়ার মতো ৷ তবে জাঙ্গিয়া থেকেও কম শরীর ঢাকে ৷ আর মহিলারা দকসারি,দকমান্দা/দকবান্দাও অনেক উপরে পড়ত ৷ এসবের জন্য আমাকে প্রচুর কথা শুনতে হয়েছে ৷ দকসারি আর দকমান্দা/দকবান্দার মধ্যে একটু পার্থক্য থাকে ৷ দকসারি একদম সাদামাটা ৷ নকশা থাকলে একটু নকশা থাকে অথবা নকশা একদমই থাকে না ৷ আর দকমান্দা/দকবান্দা পুরোটাই নকশার উপরে ৷ অনেক নকশা আছে ৷ আর কাপড়ও হয় অনেক জমকালো ৷ এ দুটো নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে অনেক ভুল ধারণা আছে ৷ এই কথাগুলো বলার কারণ হলো আমি শুনেছি যে একটা যাদুঘরে নাকি দকসারিকে দকমান্দা/দকবান্দা আর দকমান্দা/দকবান্দাকে দকসারি লেখা আছে ৷ যাদুঘরটার নামটা মনে নেই ৷ তবে আপনারা যদি কোনো সময় যাদুঘরে যান তাহলে অবশ্যই এই কথাটা মনে রাখবেন ৷ আর কথা মতো মিলিয়ে দেখবেন ৷

আমার এখনো কিছু কথা মনে আছে ৷ আমাকে আমার কিছু শিক্ষক ক্লাসের সবার সামনে অপমান করেছিল ৷ ঘটনাগুলো ভিন্ন ভিন্ন ক্লাসে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষক করেছিল ৷ আর আমার ক্লাসের বন্ধুরাও তখন আমার উপরে যেভাবে হেসেছিল সেটা আমার আজীবন মনে থাকবে ৷

আমি সবার কাছে হাসার বস্তু ছিলাম আরো কিছু কারণে ৷ সেগুলো হলো গারোদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা,মাতৃসূত্রীয় সমাজ ব্যবস্থা আর মাতৃবাস সমাজ ব্যবস্থার জন্য ৷ মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েরা হয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী ৷ ছেলেরা সম্পত্তির ভাগ পায় না ৷ সবকিছুতেই মেয়েদের প্রাধান্য থাকে ৷ মাতৃসূত্রীয় সমাজ ব্যবস্থায় সন্তানরা মায়ের পদবী ধারণ করে ৷ বংশ গণনাও মায়ের সূত্র ধরে হয় ৷ আমি মায়ের পদবী ব্যবহার করেছি বলে অনেক মানুষ হাসাহাসি করত , অনেকে অবাক হতো ৷ মাতৃবাস সমাজ ব্যবস্থায় ছেলেদের ঘরজামাই যেতে হয় ৷ আমার অনেক বন্ধু , অনেক স্যার আমাকে ঘরজামাই যেতে হবে বলে আফসোস করত ৷ এটা মূলত আফসোস ছিল না ৷ ওরা আমাকে সুন্দর করে , ভদ্রভাবে অপমান করত সেটা আমি জানতাম ৷ আড়ালে তারা এসব নিয়ে যে হাসি-তামাসা করত সেটাও আমি জানতাম ৷ আমাকে কয়েকজন জিজ্ঞেসও করেছিল যে আমার কি লজ্জা করে না মাতৃতান্ত্রিক,মাতৃসূত্রীয় ,মাতৃবাস সমাজে বসবাস করতে ৷ কীভাবে মেয়েদের অধীনে থাকি আমরা ৷ এটাও বলেছিল যে আমাদের পুরুষ বলতেও তাদের লজ্জা হয় ৷

এবার কিছু কথা বলব উপজাতি কোঠা নিয়ে ৷ উপজাতি কোঠা নিয়ে বরাবরই বাঙালিরা আমাদের খোটা দেয় ৷ এ সম্পর্কে কিছু কথা বলছি ৷ অধিকাংশ গারো(অন্যান্য অবাঙালি আদিবাসী জনগোষ্ঠীরাও) খুব গরিব হয়ে থাকে ৷ মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ না থাকায় অনেকেই পড়াশোনা পারে না ৷ ফলে ভাষা না বুঝার কারণে অনেকেই দুর্বল ছাত্র হয়ে পড়ে , অনেকে আবার পড়াশোনা ছেড়ে দেয় ৷ কিন্তু উপজাতি কোঠার জন্য অনেক দূর পর্যন্ত পড়াশোনা করতে হয় ৷ দারিদ্র্যতা আর মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ না থাকায় অনেকেই ঝড়ে পড়ে ৷ বাঙালিরা এমনভাবে বলে যেন আমাদের প্রতিটা ঘরে ঘরে চাকরিপ্রাপ্ত লোকে ভরা ৷ আমাদের ঘরে ঘরে টাকা উপচে উপচে পড়ছে ৷ বাস্তব অবস্থার কথা তো বলাই হলো ৷

আমাদের সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে ৷ এসব ভুল ধারণা প্রচারিত হয়ে থাকে পাঠ্য বই (অন্যান্য বইও ),পত্রিকা,টিভি,গুগুলের মাধ্যমে ৷ কিছু
উল্লেখযোগ্য ভুলগুলো তুলে ধরছি ৷

(১) গারোদের ভাষার নাম আ.চিক খু.সিক !
কথাটা একদমই মিথ্যা ৷ গারোদের ভাষার নাম মান্দি খু.সিক ৷ মান্দি খু.সিক আবার আঠারো ভাগে বিভক্ত ৷ আ.চিক সেই আঠারো ভাগের একটি ৷ যখন গারো অধ্যুষিত অঞ্চলে খ্রিষ্টধর্ম প্রবেশ করে তখন গারো ভাষায় বাইবেল প্রণয়ন খুবই দরকারি হয়ে পড়ে ৷ তখন গারোদের দুটি বৃহৎ কথ্য ভাষা আ.ওয়ে এবং আ.বেং এর সমন্বয়ে আ.চিক তৈরি হয় ৷ প্রথমে লিখিত ভাষা হলেও বর্তমানে এটা কথ্যে পরিণত হয়েছে ৷

(২) আ.চিক মানে সমগ্র গারো জাতিকে বুঝানো হয়!
এই কথাটাও ভুল ৷ গারোদের বাসস্থানের দুটো প্রকারভেদ আছে ৷ কিছু গারোরা পাহাড়ে বাস করে আবার কিছু গারোরা সমতলে বাস করে ৷ পাহাড় শব্দের গারো প্রতিশব্দ হলো হা.বিমা/আ.বিমা,হা.রংগা/আ.রংগা,হা.চিক/আ.চিক ৷ আর সমতল শব্দের গারো প্রতিশব্দগুলো হলো লামদা,হা.ফাল/আ.ফাল ৷ পাহাড়ি গারোরা নিজেদের হা.বিমানি/আ.বিমানি মান্দি,হা.রংগানি/আ.রংগানি মান্দি,হা.চিক/আ.চিক মান্দি বলে ৷ আর সমতলের গারোরা নিজেদের লামদানি মান্দি বা হা.ফালনি/আ.ফালনি মান্দি বলে ৷ আ.চিক শব্দটি দিয়ে শুধুমাত্র পাহাড়ি গারোদের বুঝায় ৷ সমতলের গারোদের বুঝায় না ৷ তাই আ.চিক দিয়ে সমগ্র গারো জাতিকে বুঝানো যায় না ৷ পাহাড়ি গারোদের ভাষাকে আ.চিক খু.সিক বলে ৷ উল্লেখ্য , পাহাড়ি গারোদের ভাষাকে যেমন আচিক খুসিক বলে (১৮ টা আঞ্চলিক ভাষার সবগুলোই ) তেমনি আচিক আবার লিখিত ভাষাটাকেও বলে যেটা বর্তমানে কথ্যে পরিণত হয়েছে (দুটোই কিন্তু আলাদা ) ৷

(৩) গারোদের ধর্মের নাম সাংসারেক/সাংসারিক !
গারোদের প্রাচীন ধর্মের নাম সাংসারিক না ৷ এর নাম দকবিওয়ান(দক্ -বি-ওআন্ ) ৷ যারা এই ধর্মের অনুসারী তারা সাংসারিক ৷ উল্লেখ্য , অনেক গারোও এই ভুল কথাটা সত্য মনে করে ৷

গারোদের সম্পর্কে এসব ভুল ধারণা সরকারিভাবেই প্রচার করা হচ্ছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ৷ অনেক গারোই নিজেদের সম্পর্কে জানে না ৷ জানলেও সেটা জানতে পারে বই থেকে ৷ যেগুলোর অধিকাংশই ভুল ৷

শেষ কিছু কথা বলি ৷ আমি যে চাকমা অথবা গারো তারপর আমাদের সম্পর্কে এত ভুল ধারণা , এসব আমার সমবয়সীদের কারা শিখিয়েছিল ? নিশ্চয় বড়রা ৷ কারণ , ছোটরা এসব জাত-পাত বুঝে না ৷ আমি আজও জানি আমার সম্পর্কে ছোট থেকে ভুলভাল শুনা আমার বন্ধুরা এখনও আমাদের সম্পর্কে ভুল ভাবে ৷ ওই ভুল ধারণাকে কখনোই পরিবর্তন করা যাবে না ৷ কারণ বড়রাই এর পৃষ্ঠপোষক ৷বড় হয়ে তারাও তাদের সন্তানদের এটাই শিখাবে ৷ আমি ছোটবেলায় জানতাম না বাঙালি কী , গারো কী , চাকমা কী , মুসলমান কী ,খ্রিষ্টান কী ৷ আমার উপর মানসিকভাবে করা নির্যাতনগুলো আমার উপর কী প্রভাব ফেলেছিল সেটা আমিই বুঝতে পারি ৷ সেটা কারো বুঝার মতো বা কাউকে বুঝানোর মতো না ৷ আমার গারো বন্ধুদের নিয়ে যখন বাঙালিরা হাসাহাসি করত , তখন আমার কিছু গারো বন্ধুরা সেগুলোকে হেসে উড়িয়ে দিত , যেন কিছুই হয়নি ৷ কিন্তু আমি জানতাম তাদের মনের কথা ৷ কথাগুলো হেসে উড়িয়ে দেওয়ার সময় কীভাবে তাদের চোখে পানি ছলছল করত সেটা আমি দেখেছি ৷ কয়েকজন আড়ালে আড়ালে কাঁদত , কষ্ট পেত ৷ কিন্তু বুঝতে দিত না ৷ যখন মা-বাবার কাছে অভিযোগ করতাম তখন তারাও মিথ্যা শান্তনা দিত ৷ কারণ সত্যিটা তারাও জানত ৷ তারাও এটার শিকার ৷ আপনারা যদি না জানেন শিশুদের উপর মানসিক নির্যাতন কতটুকু প্রভাব ফেলে তাহলে যারা জানে তাদের থেকে জেনে নিবেন ৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেকে আত্মহত্যাও করে ৷ সবার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে বা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ৷ আর আপনি যদি বলেন আপনি আমার (আমাদের) কষ্ট অনুভব করতে পারছেন বা বুঝতে পারছেন তাহলে সেটাও অনেকটা ভুল ৷ আগুনে দগ্ধ হওয়ার কষ্ট সেই বুঝতে পারে যে আগুনে দগ্ধ হয় ৷ আগুন থেকে দূরে দাঁড়িয়ে আপনি সেই কষ্ট কখনো অনুভব করতে পারবেনই না ৷ আপনার সন্তানদের কেউ এটার শিকার হলে তার মানসিক অবস্থাটা জেনে নিবেন ৷ আর আমাদের শিশুরাই যে এটার শিকার হয় সেটাও না ৷ সব বয়সের মানুষদের মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয় ৷ উপজাতি,ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী,জংলী,অসভ্য এসব বলে অপমান করা হয় ৷ এমনও একটা সময় ছিল যখন আমি গারোদের ঘৃণা করতে শুরু করেছিলাম ৷ নিজেকে সম্পূর্ণ বাঙালি বানিয়ে ফেলেছিলাম ৷ কিন্তু ইংরেজরা যেমন মাইকেল মধুসূদন দত্তকে দেখিয়ে ছিল সে যতই ইংরেজ হবার চেষ্টা করুন সে বাঙালিই থাকবে , তেমনি বাঙালিরাও আমাকে আঙুল তুলে আমার স্থান আমাকে দেখিয়ে দিয়েছে ৷

আমি কথাগুলো লিখছি কীভাবে সেটা আমিই জানি ৷ এই লেখার মধ্যে অনেক রাগ-অভিমান,ঘৃণা,কান্না মিশ্রিত আছে ৷ জানি এই লেখার মাধ্যমে কিছুই পরিবর্তন হবে না ৷ সারাজীবন অপমান সহ্য করেই যেতে হবে ৷ তারপরও লিখছি ৷ হয়তো কয়েকজনের মধ্যে সচেতনতা আসবে ৷ এক দাদা বলেছিল লেখার জন্য ৷ অনেকদিন না লিখেই রেখে দিয়েছি ৷ কারণ কিছুই পরিবর্তন হবে না ৷ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই নির্যাতন চলবে ৷ আপনাদের জন্য শুভ কামনা ৷ আমাদের উপর নির্যাতন চালিয়ে যান ৷ কোনো ত্রুটি রাখবেন না যেন ৷