যত দোষ করলো ইভ বা হাওয়া, খ্রিস্টান ধর্মে ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রথম নারী ইভ আর ইসলাম ধর্মে আল্লাহ’র সৃষ্ট প্রথম নারী হাওয়া ! সাপের রূপে লোভ দেখানো শয়তানের প্রলোভনে পরে নিষিদ্ধ ফল খেতে আদমকে উস্কে দিয়েছিলো ইভ বা হাওয়া, যার কারণে মানবজাতিকে স্বর্গ বা বেহেস্ততে থেকে এই পৃথিবীতে বিতাড়িত করা হয়! এই কাহিনী আমরা সবাই জানি কমবেশি। সেই থেকে খ্রিস্টান ধর্মে, মুসলিম ধর্মে, নারীকে পাপের উৎস বলা হয়। শুধু তাই নয়, হিন্দু ধর্মেও নারীকে পাপের দ্বার বলা হয়েছে। অথচ, সেই নারীর গর্ভ থেকেই ঈশ্বরপুত্র জেসাস-এর জন্ম, আল্লাহ’র প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদের জন্ম, আর হিন্দুরা তো লক্ষী, স্বরসতী , কালির রূপে নারীকে পূজাই করে থাকে। কিন্তু তারপরও এই ধর্মগুলোতে নারীকে পুরুষের অধীনস্ত করেই রাখা হয়েছে, নারীকে নেতৃত্বের ভূমিকা না দিয়ে কেবলই সেবিকার ভূমিকায় রাখা হয়েছে। কেন??
আমার মতো একজন নাস্তিকের চিন্তায় প্রথমেই প্রশ্ন আসে, স্বর্গ বা বেহেস্তে শয়তান কিভাবে ঢুকলো??? বাইবেল বা কোরান অনুযায়ী এই জায়গা সব থেকে পবিত্র যেখানে সব ভালো কিছুর স্থান, যেখানে কোনো খারাপ কিছুর থাকার বা প্রবেশ করার কথা না, সেখানে শয়তান কিভাবে প্রবেশ করলো? আর শয়তান যে প্রবেশ করলো সেটা সর্বময় শক্তির যিনি অধিকারী তিনি কেন টের পেলেন না?? যার অগোচরে পৃথিবীর একটা পাতাও নড়ে না তার অগোচরে সর্বকালের মহাপাপ সংঘটিত হয়ে গেলো কিভাবে?? নিষিদ্ধ গাছের ফল খেলে মহা অঘটন হয়ে যাবে জেনেও কেন আল্লাহ বা ঈশ্বর সেই গাছকে বিশেষ নিরাপত্তায় রাখেননি ?? মানবের সৃষ্টিকর্তা মানবিক দোষ-গুন্, দুর্বলতা সম্পর্কে কি ওয়াকিবহাল ছিলেন না?? নাকি, আদম-হাওয়া বা হবা সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট প্রথম মানব মানবী ছিল মানে আবিষ্কারের প্রথম ফল যাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট পর্যবেক্ষণাধীন ছিল, তাই সৃষ্টিকর্তা বুঝে উঠতে পারেননি যে নিষিদ্ধ ফলের ওপর আদম-হওয়ার বা হবার লোভ জগতে পারে?? আর, শয়তানই বা সব রেখে সাপের রূপ ধরে কেন আসবে?? অন্য দশটা প্রাণীর মতো সাপও তো একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি, কুকুরের কামড়েও তো মানুষ মারা যায়, আর সাপের লেজে পাড়া না পড়লে তো সাপ উল্টে কামরায় না, তাহলে সৃষ্টিকর্তার এই সৃষ্টি শয়তানের রূপে পরিণত হলো কেন?? ওপরের কোনো প্রশ্নেরই কোনো যৌক্তিক উত্তর আমার কাছে নেই, তবে শেষ প্রশ্নটার উত্তরে আমি বলতে পারি যে, সাপ তার শারীরিক গঠন ও বৈশিষ্ঠের কারণে সর্বদায়ই বেশিরভাগ মানুষের কাছে ঘৃণার ও ভয়ের পাত্র আর তাই শয়তানের চিত্রায়ন করতে এমন সাদৃশ্য আমাদের চোখে আঁকা হয়েছে যা আমাদের বেশিরভাগের কাছেই ঘৃণিত।
হাওয়া বা হবা লোভ দেখালো আর আদম যিনি প্রথম সৃষ্ট মানব, যার সাথে সৃষ্টিকর্তার বিশেষ টান, তিনি তার অধীনস্থে থাকা হবার কথায় নিজের মালিকের বিশ্বাস আর আদেশ ভাঙলো?? তাহলে নারী যদি পাপের পথের দ্বারই হয়, তবে বলবো পুরুষতো বিশ্বাস ভংগের প্রতীক, অবাদ্ধতার প্রতীক। যে কিনা দুইদিন ধরে সৃষ্ট হবার কথায় নিজের মালিকের আদেশ অমান্য করতে পারে তাকে আর যাই হোক বিশ্বাসের জায়গায় তো রাখা যাই না। তারমানে আদমের সাথে সৃষ্টিকর্তার সম্পর্কটা এতটাই ঠুনকো ছিল যে হবা টোকা দিতেই তা ভেঙ্গে পড়েছে। ঠিক যেমন, মাদ্রাসা গুলোতে ধর্মজ্ঞান দেয়া আলেমরা বিভিন্ন সময়ে মেয়ে ছাত্রীদের দেখে যৌন লোভ সামলাতে না পেরে আল্লাহ’র বিধি নিষেধ জলাঞ্জলি দিয়ে যৌনঅত্মাচারে লিপ্ত হয়। কিন্তু ”নারী মানেই কামনা বাসনা”- তাই এক্ষেত্রেও নারীদেরই দোষ। শিশু থেকে কিশোরী, যৌবনা সম্পুন্ন, বিবাহিত, সন্তানের মা, বয়স্কা, যে কোনো ধরণের নারী দেখলেই যে তাদের লোভ সামলে থাকে না, হিতাহিত ধর্মজ্ঞান থাকে না, সেই বেলায় কোনো দোষ নাই, যত দোষ হলো হাওয়া বা হবার।
বিভিন্ন ধর্মে নারীর ভূমিকা বা মর্যাদা নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে দেখলাম বিভিন্ন লেখায় ভিন্ন ভাবে বলা হয়েছে প্রতিটা ধর্ম সম্পর্কেই যে সেই ধর্মে নারীদের যতটা সম্মান দেয়া হয়েছে তা আর অন্য কোনো ধর্মে দেয়া হয় নাই। মানে একটা লেখায় পেলাম, ‘ইসলামই সর্বপ্রথম নারীদের যথাযোগ্য সম্মান দেয় (বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম , 2014)‘। আর একটাই পেলাম, “হিন্দু ধর্মে নারীদের সর্বোচ্চ সম্মান দেয়া হয়েছে“, অন্যটিতে পেলাম, ” একমাত্র খ্রিস্টান ধর্মে নারীকে সর্বচ্চো স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে“। তাহলে স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেস্ত কেন? কোনো ধর্মে নারীকে ধর্মীয় আচার পালনে পুরুষের সমান যোগ্যতা পরিধার্য করা হয়নি কেন? কেন নারীকে বাল্যকালে পিতা, যৌবনে স্বামী ও বৃদ্ধকালে ছেলের ছায়াতলে থাকতে বলা হয়েছে (বিজয়, 2016)? কেন, কেন বৃদ্ধ স্বামীর পরলোগমনে যৌবনাসম্পূন্ন বিধবা স্ত্রীকে স্বামীর চিতায় দাহ হতে হয়েছে? কেন নিজের পুরো জীবন যৌবন, পরিবার-পরিজন ত্যাগ করে, ঈশ্বরের কাজে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েও গির্জার কাজে নারীরা শুধুই সেবিকার স্থান পেয়ে গেলো? পরিবারের কেউ মৃত্যুবরণ করলে নারীদের সৎকারের কাজ করার অধিকার দেয়া হয় নাই। এমনকি নারীর মৃত্যুতে তার সৎকারকার্যে পবিত্র গীতা থেকে কোনো পাঠ করার নিষেধ আছে I স্ত্রীর পরম গুরু হল স্বামী। এমনকি স্ত্রীকে শাসন করা বা শারীরিক শাস্তি দেওয়ার অধিকারও স্বামীর আছে। কেন বলা হলো যে পতির সেবা করাই নারীর জন্য বেদপাঠের ন্যায় পুন্য (বিজয়, 2016)?? ঈশ্বর তার প্রতিচ্ছবিতে আদম কে সৃষ্টি করেছেন, আর হাওয়া বা হবা কেবলই আদমের বুকের পাঁজর থেকে গড়া দ্বিতীয় ‘প্রজাতির‘ মনুষ্য যে আদমের ন্যায় শ্রেষ্ঠ বা সমতুল্য নয়, কেন এই কথাই বা বলা হয়ে থাকে যদি প্রত্যেক ধর্মই কোনো না কোনোভাবে দাবি করে যে তাদের ধর্মেই নারীকে সর্বোচ্চ সম্মান বা অধিকার বা স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে?
নারীকে ওরা আসলে উর্বর জমি ছাড়া আর কিছুই মনে করে না। অন্যথায় বলতে গেলে, নারীর এক অসীম ক্ষমতা আছে যা হলো সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা। পৃথিবী যত উন্নতি করুক আর যত কৃত্তিমতায় ভোরে যাক, এই ক্ষমতার কোনো হের্ ফের হবে না। তাই নারীকে দমিয়ে বশে রাখা অত্যন্ত জরুরি এ বেপারটা বহুকাল আগেই ধর্মের কান্ডারীরা বুঝে নিয়েছে আর তাই নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী নারীদের অধীনস্থ করে ধর্মের ব্যাখ্যা দিয়েছে। যেকোনো ধর্মকে টিকিয়ে রাখতে হলে জনসংখা বাড়ানোটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় আর সে কারণেই ধর্ম গ্রন্ধ গুলোতে বার বার বংশবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। আর মায়ের কাছ থেকেই সন্তান প্রথম জ্ঞান লাভ করে, তাই নারীকে দমিয়ে ঘর ও সন্তান পালন কেন্দ্রিক করে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে যার নিগুড় উদেশ্যই হলো ধর্মের ব্যবসাকে সচল রাখা। যাচাই করে দেখলে দেখা যাবে, বিভিন্ন ধর্মকে টিকিয়ে রাখার পেছনে নারীদের ভূমিকা অপরিসীম, কাজের ব্যস্ততার কথা বলে পুরুষরা ধর্মীয় কাজে অংশগ্রহণ কম করে, কিন্তু পূজা পার্বন, ঘরে ঘরে সন্ধ্যারতি, ইফতার ও সেহরির ব্যবস্থা করা, রবিবারে গির্জায় যাওয়া, এসব কাজ মেয়েরা করে আসছে বলেই হিন্দু আচার ও রীতি টিকে আছে, মুসলিমরা সময়মতো নামাজ রোজা কায়েম করতে পারছে, আর খ্রিস্টানদের গির্জা এখনো পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে যায়নি (হোসেন, 2009)। মূলত এই কারণেই সমকামিতাকে আরো বেশ ঘৃণার চোখে দেখা হয় ধর্মগুলোতে, কারণ সমকামিতা বৃদ্ধি মানে সন্তান জন্মদান কমে যাওয়া আর এর মানে জনসংখ্যাই স্খলন। তানাহলে, বাইবেল এর পুরাতন নিয়মে যেখানে সন্তান জন্মদানের উদেশ্যে দুই কন্যা পিতাকে মদ খাইয়ে মাতাল করে পিতার সাথে সহবাস করে গর্ভধারণ করে, এই ঘটনাকে পাপ বলে ধিক্কার জানানো হয়না, সেখানে আজকের দিন পর্যন্ত সমকামিতাকে আইনি অধিকার দেয়া কেন হবে না (BBC News Bangla, 2023)??
নারীকে তাই দমিয়ে রাখতে তাকে নরকের দ্বার, কাম-লালসার উৎস, পাপের প্রলোভন ইত্যাদি বলে আখ্যা দিয়েছে বিভিন্ন ধর্মের মনীষীর। ঋতুস্রাবের মধ্যে দিয়ে সৃষ্টির একটি বিশেষ শক্তি নারীকে দেয়া হয়েছে যেটাকে অচ্ছুৎ বলে নারীর ক্ষমতাকে নিচু করা হয়েছে। বংশ বৃদ্ধির একমাত্র পথ নারী তাই নিজের সম্পত্তির মতো নারীকে পর্দার আড়াল করে নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে বন্দি করা হয়েছে। ‘কুমারীত্ব‘ নামক ভয়ংকর অস্ত্র দিয়ে নারীকে ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখা হয়েছে। তানাহলে এই শব্দটা কেবল নারীর বেলায় কেন প্রযোজ্য হবে, পবিত্রতা কি শরীর দিয়ে হয় নাকি মন থেকে আসে ? ওযু করে মসজিদে ঢুকলেই কি মন পবিত্র হয়ে যায়? স্বামীর সাথে সহবাসের পরে নারীদের গোসল করতে হয়, পুরুষদের কি সহবাসের পর শরীর ধোয়ার প্রয়োজন হয় না ? ঋতুস্রাব হলে মেয়েদের ধর্মের কাজে অংশ নেয়া বারণ, কিন্তু সেই মাসিক হওয়া নারীর সাথে সহবাস করলে সেই পুরুষের ধর্মীয় কাজে অংশ নিতে তো বারণ নেই ?
আসলে নারীকে মানুষ হিসেবেই গণ্য করা হতো না যদি না নারীর সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা না থাকতো। পুরুষরা শুধু নারীর শরীরটাকেই বিবেচনায় রেখে ধর্মীয় রীতির নামে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের পথ বানিয়েছে। নারীরা যদি সে ব্যাপারটা না বুঝে ও নিজের সমধিকারের জন্য লড়াই না করে তবে যুগের পর যুগ ধরে কেবল একটি যৌনআবেদনময়ী প্রাণী ও বাচ্চা হওয়ার মেশিন হিসেবেই গণ্য হয়ে যাবে।
গভীরভাবে চিন্তা করলে পৃথিবীর সেরা জীব আসলে নারী। কারণ মাটিতে বীজ পড়লে যেমন গাছ হয়, ফল ধরে, তেমনি নারী সন্তান ধারণ করে। এমন একটি শ্রেষ্ঠ ক্ষমতার অধিকারী নারী। নারী ভালোবাসার প্রতীক, কারণ সে একজনকে ভালোবেসে নিজের প্রিতৃগৃহ ত্যাগ করে স্বামীর পরিবারের অংশ হয়, চরম সাহসিকতার কাজ এটা। নারী অনুভূতি বোঝে, ভালোবাসা বোঝে, ত্যাগ করতে জানে। সংসার সামলানোর মদ্ধ দিয়ে নারী কাজও বেশি করে। বছরের পর বছর নিজের যৌন চাহিদা উপেক্ষা করে স্বামীর যৌন ক্ষুধা মেটায়। অভাবনীয় যন্ত্রনা ভোগ করে, মাসের পর মাস কষ্ট করে জন্মদানের মতো সাহসী কাজ নির্দ্বিধায় করে। যার এত্ত সব গুন্ সে শ্রেষ্ট না হয়ে বরং যে শ্রেষ্ঠত্ব ফলায় অন্যের ওপর সে কেন শ্রেষ্ঠ হতে যাবে ?
References
BBC News Bangla, 2023. সমকামী বিয়েকে বৈধতা দিল না ভারতের সুপ্রিম কোর্ট, s.l.: BBC NES Bangla.
বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম , 2014. কেমন আছেন অন্য ধর্মের নারীরা. বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম , 23 MArch.
বিজয়, 2016. পুরুষ রচিত ধর্মের চোখে নারী –পর্বঃ০১ (হিন্দু ধর্ম). [Online]
Available at: http://www.muktochintablog.com/blogpost/details/20532
[Accessed 20 October 2023].
হোসেন, ন., 2009. খ্রীষ্টধর্মে নারী এবং খ্রীষ্টিয়ান নারীবাদীদের ‘ধর্মকথন’ ।. [Online]
Available at: https://blog.muktomona.com/2009/04/16/1526/
[Accessed 20 October 2023].