ধর্মের একটা বড় প্রভাব রয়েছে সমকামিতার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষদের মধ্যে একটি ঘৃণা ও বিভ্রান্তি তৈরী করবার জন্য। এটি বলতে দ্বিধা নেই যে ধর্ম নামের অহেতুক সময় অপচয়কারী উপাদানগুলোর জঘন্য চিন্তার বাই প্রোডাক্ট হচ্ছে গন্ড মূর্খ জনগোষ্ঠী, অশিক্ষিত সমাজ এবং অরাজকতা।

সমকামিতা যে একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার ও এটি একজন মানুষের নিজস্ব পছন্দের ব্যাপার এটি ধর্ম রিকোগনাইজ করেনা। ধর্মের অসংখ্য অসভ্য আচরণের মধ্যে এটি অন্যতম। একজন ব্যাক্তি কার সাথে শোবেন কিংবা কার সাথে যৌন সম্পর্ক করবেন এটি কি নির্ধারণ করে দেবার মত কিছু? এটি তো রীতিমত নোংরা একটা ব্যাপার যে ধর্ম বলে দিচ্ছে আপনি কার সাথে সেক্স করতে পারবেন কিংবা করতে পারবেন না।

ইসলামী আইন গড়ে উঠেছে মধ্যযুগে। মধ্যযুগের ধর্মীয় আইনের কাজ ছিল রাজতন্ত্রের বৈধতা দেয়া এবং রাজতন্ত্রের শক্তিতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। মধ্যযুগীয় রাজা বাদশাহ অথবা উচ্চবিত্ত্ব মুসলমানের জীবনে সমকামিতা অপরিচিত কিছু ছিল না, বরং বহুল প্রচলিত ছিল বলেই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। সমকামিতার অপরাধে মৃত্যুদন্ড অথবা যে শাস্তির কথাই মুসলিম উলামারা বলুক না কেনো, সেই বিচার যে প্রজার উপর শাসনেই ব্যবহৃত হতো এবং রাজপুরুষরা যে বিচারের আওতায় বাইরেই থাকতেন, মুসলিম স্পেনের খলিফা দ্বিতীয় আল হাকাম (৯১৫-৯৭৬) তার একটি উদাহরণ। খলিফা আল হাকাম স্পেনের উমাইয়া খলিফাদের মধ্যে সবচাইতে বিখ্যাত ও সফলদের একজন। রাজনৈতিক সাফল্যের পাশাপাশি বিদ্যানুরাগী হিসাবে তিনি খ্যাতিমান ছিলেন।

তৎকালিন দুনিয়ার বিদ্যা শিক্ষার জন্যে বিখ্যাত সকল কেন্দ্র থেকেই বই পত্র সংগ্রহ করে তিনি কর্ডোবায় জমা করেছেন। তার নিজের ব্যক্তিগত পাঠাগারেই না কি ছয় লাখের উপর বই ছিল। জ্ঞান বিজ্ঞান ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে আব্বাসিয় খেলাফত শাসিত সূদুর পারস্যেও তাকে উৎসর্গ করে বই লেখা হতো। আল হাকাম নিজেও একজন বিদ্যান ব্যক্তি ছিলেন, বিশেষ করে ইতিহাস শাস্ত্রে। তিনি মুসলিম স্পেন তথা আল আন্দালুসের ইতিহাসের উপর একটি বইও লিখেছেন।

এই ক্ষমতাধর ও খ্যাতিমান খলিফা ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন সমকামী, এবং এইক্ষেত্রে কোন লুকাছাপা করেন নাই। তার হারেমে কোন নারী ছিল না, শুধুমাত্র পুরুষদের নিয়ে তিনি হারেম বানিয়েছেন। কিন্তু রাজপুরুষ হিসাবে তার উত্তরাধিকার রেখে যাওয়ার দরকার ছিল। এই প্রয়োজন মেটাতে তিনি সুবহ নামে একজন উপস্ত্রী গ্রহণ করেন। সুলতানা সুবহ পুরুষদের মতো পোষাক পড়তেন এবং খলিফা হাকাম তাকে ডাকতেন জাফর নামে। আল হাকাম এবং সুবহের সন্তানদের মধ্যে ছিলেন পরবর্তি খলিফা দ্বিতীয় হিশাম এবং কবি, ব্যকরণবীদ ও গানিতিক লুবনা যিনি মদিনা আজহারা গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন।

আসল কথা হলো, খলিফা দ্বিতীয় আল হাকামকে সমকামিতার অপরাধে বিচার করা দূরে থাক তার বিরুদ্ধে কোন মুসলিম উলামা বিচারের দাবী তুলেছেন সেইরকম কোন ইতিহাস পাওয়া যায় না। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, স্পেনে মালেকি শরিয়া প্রচলিত ছিল এবং ইমাম মালিকের মতে সমকামিতার শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড।
ধর্মে যেমন নেই মানুষের স্বাধীনতা ঠিক নেই একজন মানুষের যৌন পছন্দ ও অপছন্দের স্বাধীনতা। ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের গ্রন্থ কোরান থেকেই কিছু উদাহরন দেয়া যেতে পারে। যেমন-
এখানে বলা হচ্ছে যে- তারা চতুষ্পদ জন্তু-জানোয়ারের মতো, বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট (সুরা আরাফ- ১৭৯)।

ইতিহাস সাক্ষী- অভিষপ্ত গোষ্ঠি কওমে লুত সমকামের অপরাধে ধ্বংস হয়েছিল। হজরত লুত তাদেরকে বার বার হালাল পন্থায় নারীদের সঙ্গে যৌন চাহিদা পূরণ করার অনুরোধ করেছেন। কিন্তু কওমবাসী তার কথা শুনেনি। ফলাফল কী হয়েছিলো? আল্লাহ মহান হজরত জিবরাইলকে (আ.) পাঠিয়ে কওম লুতকে আজাব দিলেন। ধ্বংস করে দিলেন একটি জনপদকে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, অতপর যখন আমার হুকুম এসে পৌঁছল, এরপর যখন আমার সিদ্ধান্ত কার্যকর হলো, তখন আমি জনপদের উপরিভাগ নিচে এবং নিম্নভাগ উপরে উঠালাম এবং তার উপর স্তরে স্তরে কাঁকর-পাথর বর্ষণ করলাম। (সুরা হুদ: ৮২)।

ইসলামে সমকামিতা ব্যভিচারের চেয়েও জঘন্য পাপ হিসেবে বিবেচিত হয়। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যাদেরকে তোমরা লুতের সম্প্রদায়ের কাজে (সমকামে) লিপ্ত দেখবে তাদের উভয়কেই হত্যা করো। (তিরমিজি: ৪/৫৭; আবু দাউদ: ৪/২৬৯; ইবনে মাজা: ২/৮৫৬)।

হজরত আবু মুসা আশআরী (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুল (সা.) বলেছেন, যে পুরুষ পুরুষের সাথে নোংরা কাজে লিপ্ত হয়, উভয়ে ব্যভিচারকারী হিসেবে সাব্যস্ত হবে। তেমনি যে নারী আরেক নারীর সঙ্গে কুকর্মে লিপ্ত হয় উভয়ে ব্যভিচারকারী হিসেবে সাব্যস্ত হবে। (শুয়াবুল ঈমান)
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা যদি কাউকে পাও যে লুতের সম্প্রদায় যা করত তা করছে, তবে হত্যা করো। যে করছে তাঁকে আর যাকে করা হচ্ছে তাকেও। (আবু দাউদ ৩৮:৪৪৪৭)

হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, আমি আমার উম্মতের জন্য সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা আশঙ্কা করি সেটা হলো লুতের উম্মত যা করত সেটার অনুসরণ করা। (তিরমিজি)

এই হচ্ছে ইসলাম ধর্মের মধ্যে মানুষের অধিকারের স্বরূপ। পড়েই তো মনে হচ্ছে কি জঘন্য এবং কি ভয়াবহ বর্বরতা! সমকামিতা যে কোনো ধর্মেই নিষিদ্ধ। ধর্মে কোনো কিছু নিষিদ্ধের একটি কারণ হচ্ছে তা সমাজের জন্য ক্ষতিকর। ধর্ম কোনো ক্ষতিকর বিষয়কে সমাজের জন্য অনুমতি দেয় না। এ জন্যে সমকামী নারী ও পুরষকে গোপনে তাদের জীবন যাপন করতে হয়! সমকামিতার বৈধতার চ্যালেঞ্জ নিয়ে মাঠেও নেমেছে সমকামীরা।

আমার কাছে খুবই সুনির্দিষ্ট ভাবে মনে হয় যে ধর্ম একটা বড় প্রভাবক এইসকল ট্যাবু তৈরী করবার ক্ষেত্রে আর এই ধর্মের এইসব জিঞ্জির না ছিঁড়ে ফেললে সমকামিতার মত স্বাভাবিক বিষয়াদিও আসলে সব সময় প্রশ্নবিদ্ধ হতেই থাকবে।