বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বয়ে নিয়ে চলছে – এ কথাটা বলা একদম অযৌক্তিক বলে আমি মনে করিনা। কারন আসন্ন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মহা উৎসব দুর্গা পুরা শুরু হওয়ার আগেই শুরু হয়ে গেছে বাংলাদেশের মুমিন সমাজের রাহাজানি। তারা সমানে হিন্দুদের দেবদেবীর মুর্তি ভাংচুর শুরু করেছে। আবার সোশাল মিডিয়াতে তর্ক বিতর্ক হচ্ছে যে বাংলাদেশের মানুষ কি আসলেই সাম্প্রদায়িক না এখনও সেক্যুলারিজমে মানুষ বিশ্বাস করে – এই বিষয়গুলো নিয়ে।

সোশাল মিডিয়ার কিবোর্ড ও্যারিওরদের মধ্যে এক গ্রুপ লিখলো, “ধর্ম যার যার কিন্তু উৎসব সবার” … এই যদি হয় মানুষের মনোভাব, তাহলে দুর্গা পূজার আগে পত্রিকা খুললেই কেন মুর্তি কিংবা প্রতিমা ভাঙ্গার খবর দেখতে পাওয়া যায়? কেন তারা হামলা করে মন্দিরে? কিসের সেক্যুলারিজম এসব?

অভিনেত্রী মৌ, মিথিলা, নুসরাত ফারিয়া, ক্রিকেটার মুশফিক, লিটন দাশ দুর্গা পূজার মডেলিং করে কিংবা শারদীয়া শুভেচ্ছা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে চরমভাবে নিগৃহীত হয়েছে। তাদের পোস্ট গুলোতে যারা মন্তব্য করেছে তারা রাজনৈতিক কোন নেতা নয়, ক্যাডার নয়, ওলামা লীগের সদস্য নয়। তারা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, যারা সামাজিকভাবে দেশে অন্যদের থেকে বেশি সুবিধা ভোগ করে, কারণ ফেসবুকে কমেন্ট করার মতো সঙ্গতি তাদের আছে।

কেউ কেউ অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের উদাহরণ টানতে, একজন টুপি পরা ভ্যান চালকের ভ্যান গাড়িতে দুর্গা প্রতিমা নিয়ে যাওয়ার ছবিটিকে বারবার তুলে ধরেছে আবার কেউ কেউ পাজামা পাঞ্জাবিপরা ছোট শিশুটির মন্দিরের দরজায় দাঁড়িয়ে ঠাকুর দেখার ছবিটি টেনেছে। এ-ছবি দুটো যদি অসাম্প্রদায়িকতার প্রমাণ হয়, তাহলে শত শত মণ্ডপ তছনছ করা, প্রতিমা ভাঙার ছবি কিসের সাক্ষ্য বহন করে?

এবার একটু ইতিহাসের দিকে তাকাইঃ

বৃটিশরা ভারতবর্ষ ভাগ করেছিলো ধর্মের ভিত্তিতে।

একটা দেশ গঠনে চারটি উপাদান লাগে বলে আমরা জানি। সেখানে ভৌগোলিক অবস্থান, জাতীয়তা, ভাষা তিনটি মৌলিক উপাদান আমাদের বিপক্ষে থাকা সত্ত্বেও শুধু ধর্মীয় কারণে বাংলাদেশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান নাম দিয়ে ২২০৪ কিলোমিটার দূরে পাকিস্তানের লেজুড়ের সাথে জুড়ে দেয়া হয়। খাদ্য অভ্যাস, পোশাক, সংস্কৃতি ইত্যাদির পার্থক্যতো বাইরেই থাকলো। আকাশপথ ছাড়া সরাসরি একই দেশের দু প্রান্তে আসা যাওয়ার আর কোন সুযোগ ছিলো না। অন্য একদেশ মাঝখানে পেরিয়ে পাকিস্তানের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে হতো।

বৃটিশেরা আমাদের মধ্যে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে এমন আবোল তাবোল ভাবার কোন সুযোগ বা যুক্তি নেই। বৃটিশেরা দু’শ বছর ভারতবর্ষ শাসন করে জেনে গেছিলো, ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের দুর্বল স্থান কোনটি, কোথায় আমাদের লাগে। আমাদের কাতরতা কোনটি নিয়ে বেশি, কী করলে আজীবন আমাদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণার চর্চা কখনো শেষ হবে না। তারা উপযুক্ত স্পর্শকাতর স্থানটুকু চিহ্নিত করে ব্যবহার করেছে মাত্র। চিঙ্গারি গরমই ছিলো, শুধু আগুনটুকু ঠুকে দিয়েছে তারা।

সাম্প্রদায়িকতা ভারতবর্ষের মানুষের রক্তে রক্তে। বহু বছরের চর্চা আমাদের। আমাদের ইতিহাস এর সাক্ষী। ১৯৪২ এ বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে বৃটিশ সৈন্যরা যতো ভারতীয় মেরেছিলো তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ দেশভাগের সময় দাঙ্গায় মারা গিয়েছিলো। ১৯৭১ সালে ঝরেছে তিরিশ লক্ষ তাজা প্রাণ। ১৯৭১ সালের যুদ্ধেও ধর্ম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বাঙালির বিরুদ্ধে অবাঙালিরা ব্যবহার করেছিলো।

রবীন্দ্রনাথকে সাক্ষী রাখছি, “আজ আমরা সকলেই এই কথা বলিয়া আক্ষেপ করিতেছি যে, ইংরেজ মুসলমানদিগকে গোপনে হিন্দুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিয়া দিতেছে। কথাটা যদি সত্যই হয় তবে ইংরেজের বিরুদ্ধে রাগ করিব কেন। দেশের মধ্যে যতগুলি সুযোগ আছে ইংরেজ তাহা নিজের দিকে টানিবে না, ইংরেজকে আমরা এতবড়ো নির্বোধ বলিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিব এমন কী কারণ ঘটিয়াছে।

মুসলমানকে যে হিন্দুর বিরুদ্ধে লাগানো যাইতে পারে এই তথ্যটাই ভাবিয়া দেখিবার বিষয়, কে লাগাইল সেটা তত গুরুতর বিষয় নয়। শনি তো ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না; অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই সাবধান হইতে হইবে। আমাদের মধ্যে যেখানে পাপ আছে শত্রু সেখানে জোর করিবেই– আজ যদি না করে তো কাল করিবে, এক শত্রু যদি না করে তো অন্য শত্রু করিবে– অতএব শত্রুকে দোষ না দিয়া পাপকেই ধিক্কার দিতে হইবে।

হিন্দু-মুসলমানের সম্বন্ধ লইয়া আমাদের দেশের একটা পাপ আছে; এ পাপ অনেক দিন হইতে চলিয়া আসিতেছে। ইহার যা ফল তাহা না ভোগ করিয়া আমাদের কোনোমতেই নিষ্কৃতি নাই। ”

আসলে বলতে গেলে আমাদের গোটা দেশের ৯০ ভাগ মানুষই সাম্প্রদায়িকতার বীজ বয়ে চলছে। বাকি ১০ শতাংশ চাইলেও তাদের কিছু করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। সাম্প্রদায়িকতার এই বীজ উপড়ে ফেলে দিতে হলে সবার আগে ধর্ম ভিত্তিক সকল রাজনীতি বন্ধ করে দিতে হবে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কি আদৌ কোন দরকার আছে বলে মনে হয় আপনার? তারা বিভেদ, হানাহানি ও সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো ছাড়া আর কি করে মূলত? তাদেরকে সমূলে উৎখাত করতে পারলেই বাংলাদেশ একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রে পরিণত হবে।