সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা॥
তনয় এর খুব পছন্দের একটি গান। প্রায়ই সে গুন গুন করে গাইত গানটি। যদিও ওর পছন্দের গানের তালিকা অনেক বড়। গান গাইতে বললেই শোনাত। ভণিতা করতো না অনেকের মতন। মূলত থিয়েটার বিষয়ক একটা কাজের সহায়তার জন্য তনয়ের সাথে আমার পরিচয় ২০১৩ সালে। তখন বয়েজ অব বাংলাদেশের “প্রণয়নামা” অনুষ্ঠানে আমরা একটি ছোট মঞ্চ-নাটিকা এর মতন করতে চাই। পারদর্শী ও অভিজ্ঞ মানুষের অভাব। এক টিভি চ্যানেলে ওর একটা সাক্ষাৎকার দেখে সেই খাতিরে যোগাযোগ করা। কথা হল। দেখা হল। কাজের কথার ফাঁকে ফাঁকে ওকে জানা হল। যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং ও গভীর মানুষ বলে মনে হল। সে যথেষ্ট ধৈর্য ধরে আমাদের ছেলেমানুষি নাটকের কাজ প্রায় পঞ্চাশ ভাগ এগিয়ে দিল। একটা বার কোনও অভিযোগ বা সমালোচনা না করে মুল অনুষ্ঠানে লাইট আর মিউজিক এর কাজও সে করে দিল। করে ফেললাম আমরা বাংলাদেশের প্রথম সমকামী প্রেমের গল্প নিয়ে করা কোন একটা ছোট মঞ্চ-নাটিকা। এভাবে তনয় এর আমাদের সাথে ধীরে ধীরে অ্যাক্টিভিজমে জড়িয়ে পরা। সে পুরাদস্তুর একজন মঞ্চ-নাট্য কর্মী। একযুগেরও বেশি সময় ধরে লোকনাট্য দলে ওর যাতায়াত। আমরা দল বেঁধে তার নাটক দেখতে যেতাম, ‘কঞ্জুস’ এর কালা মিয়া বা ‘লীলাবতী আখ্যান’ এর মহারাজা হিসাবে ওকে দেখতাম। ওর অভিনয়ে অনেক অবাক হতাম। কিভাবে পারে?
ক্যারিয়ার নিয়ে ওর মধ্যে প্রায়ই হতাশা দেখতে পেতাম। সারাক্ষণই নাটকের দলের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ওকে দেখতাম ছুটাছুটি করতে। এরপর যোগ হল বয়েজ অব বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবকের কাজ। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে বলতাম গ্রাজুয়েশনটা করলে না টাকার অভাবে আর এদিকে নিজের জীবন দিয়ে দিচ্ছ সব স্বেচ্ছাসেবক কাজে, যেখানে টাকা তো আসেই না উল্টো পকেট থেকে যায়। সে কথাগুলো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে বলত, “বুঝবেনা তুমি এসব প্যাশন”। ২০১৪ সালে বয়েজ অব বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসের অনুষ্ঠানে সে মুঘল সাম্রাজ্যের সূফী কবি শাহ্ হুসেইন ও তার ব্রাহ্মণ প্রেমিক মধু লাল কে নিয়ে একটা ‘স্যাডো পাপেট’ পরিবেশন করে। অনেক এক্সপেরিমেন্টাল ছিল সেটা। খুব অল্প সময়ে করাতে হওয়ায় তনয় নিজে তেমন সন্তুষ্ট ছিল না তাই তার পরিকল্পনা ছিল এটাকে সে বড় আকারে কোন একটা মঞ্চে আবার পরিবেশন করবে। যেন মানুষ জানতে পারে এই হারিয়ে যাওয়া প্রেমের গল্পটি। সেটা আর তার করা হল না।
২০১৪ এর শেষের দিকে কিছু ব্যক্তিগত সমস্যায় আমরা কজন বয়েজ অব বাংলাদেশ ছেড়ে দেই এবং আমি আর তনয় রূপবানে জয়েন করি এক্সিকিউটিভ কমিটি মেম্বার হিসাবে। তনয় হয় জেনারেল সেক্রেটারি আর জুলহাজ মান্নান প্রেসিডেন্ট। রূপবানের জন্য সকল দৌড়ঝাপ তনয়ই বেশি করতো। সেগুলো চাইলেও জুলহাজ ভাই তার কাজের ক্ষেত্রের কিছু দায়বদ্ধতা থেকে পারতেন না। তিনি সবসময় চাইতেন মানুষ রূপবান বলতে তনয়কে চিনবে। সেটা রূপবান ইয়ুথ লিডারশীপ প্রোগ্রাম হোক বা হোক ‘পিঙ্ক স্লিপ’ কিংবা ম্যাগাজিন বা ‘রূপঙ্ক্তি’ প্রকাশনার কাজ। বলতেই হয় ‘ রূপঙ্ক্তি’ ওর কাছে কতোটা আবেগের একটা প্রোজেক্ট ছিল। শেষ সময়ে প্রকাশক খুঁজে বের করা, দুইদিন লাগিয়ে প্রুফ রিডিং করে একুশে বইমেলায় উদ্বোধনের মতন অসাধ্য সাধন করাটা ও বলেই সম্ভব হয়েছিল। ২০১৫ সালের একুশের বইমেলাতে অভিজিৎ রায় খুন হওয়ার পরদিন ছিল আমাদের ‘ রূপঙ্ক্তি’র প্রকাশনার উদ্বোধন তাও অভিজিৎ রয়ের বইগুলোর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুদ্ধস্বর থেকে। সেই ভয়কে জয় করে আমাদের বইমেলায় যাওয়াই হতো না যদি জুলহাজ ভাই আর তনয় সাহস যোগাতো।
মঞ্চনাটকের সাথে এতো বছর জড়িত থাকতে থাকতে ওর মাঝে ‘ইম্প্রোভাইজেশন’ এর ব্যাপারটা সহজাত হয়ে গিয়েছিল। আমাদের কারো কারো কাছে ব্যাপারটা অপছন্দনীয়ও ছিল বটে। জুলহাজ ভাই প্রায়ই ওকে বকা দিতেন আর বলতেন আমাদের মিটিং-এ, “আপনার অনেক পটেনসিয়ালিটি আছে কিন্তু এভাবে অলসতা করে ইম্প্রোভাইজেশন দিয়ে আর কতদিন? কাজের মান তো কমে যাচ্ছে আপনার”। মিথ্যা বলা হবে যদি না স্বীকার করি যে আমরা বিভিন্ন কাজে যতবার ঝামেলাতে পড়েছি, তনয়ের ইম্প্রোভাইজেশন কোয়ালিটির গুণে সেখান থেকে ঠিকই উতরে গিয়েছি বা পাশ কাটাতে পেরেছি। এখন সেটা বুঝতে পারি। সত্যি কথা বলতে গেলে এটা আমাদের অনেক কাজে সাহায্য করেছে। অনেক কিছু সে সহজে ম্যানেজ করে ফেলতে পারত। কত প্রোগ্রাম বা ইভেন্ট সে স্বল্প খরচে করে ফেলত! আইডিয়া ওর মাথায় গিজগিজ করতো।
কমিউনিটির কিছু মানুষ ওকে আগাগোড়া অপছন্দ করত। কিছু কারণ আমাদের দুজনেরও অজানা ছিল। ব্যক্তিগত ক্লেশ বা ক্ষোভ থেকে হতে পারে যদিও। সেই মানুষগুলো মাঝে মাঝে ওকে কারণে অকারণে সবার সামনেই অপমানসূচক কথা বলতে ছাড়ত না। সে হাসিমুখে সব কথা হজম করে নিত। আর দিন শেষে ফোনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাকে বলত। প্রথমদিকে চেষ্টা করেছিল তাদের প্রিয় পাত্র হতে কিন্তু ফলপ্রসূ হয়নি। অনেক বলেছি একটু একহাত দেখে নাওনা কেন ওদের! আমিতো ছেড়ে দিতাম না। কিন্তু সে বলত, একদিন ওরা ওদের ভুল বুঝতে পারবে। মাঝে মাঝে যদিও ভেঙ্গে পড়তো আর বলতো, হয়তো তাদের ঘৃণা আমি ডিসার্ভ করি আসলেই। আমি নিজেও মাঝে মাঝে নিজ উদ্যোগে চাইতাম তাদের ভুল ভাঙতে কিন্তু ওর বারণের কারণে পারতাম না। জুলহাজ ভাইও আশা করতেন এসব একসময় ঠিক হয়ে যাবে ধীরে ধীরে।
ওর কাছে কমিউনিটি ছিল হাঁফ ছাড়ার জায়গা। এখানে তাকে অভিনয় করতে হতো না। নিজের মতন আচরণ, চলন বলনের সুযোগ ছিল। চাইলে একটা শাড়ী বা গাউন পরে ফেলা যেত। পুরুষালী মোচ নিয়ে মেয়েলী কাপড়ে ওকে কেন জানি মানিয়ে যেতো। নিজেকে সে প্যানসেক্সুয়াল বলত। ওর ভাষায়, “ভালোবাসার আবার লিঙ্গ কি”? এতো ভারি শরীর নিয়েও সে সুন্দর বেলি ড্যান্স করতে পারত! যেকোনো কমিউনিটির প্রোগ্রাম হলেই ওর ডাক পড়ত। প্রোগ্রাম পরিকল্পনা বা পারফরম্যান্স, যা করতে মানুষ আবদার করতো সেটা সে সবকাজ ফেলে নিজ গরজে করে দিত।
তনয়ের বাসার পরিবেশটা একটু অন্যরকম। বাসার সবাই জানত তাদের ছেলে একটু আলাদা। পাড়ার আর দশটা ছেলের মতন নয়। ছোটবেলা থেকেই সে নিজেকে লুকাতে চাইতো না। ছেলে হয়ে মেয়েলী স্বভাব, মেয়ের কাপড়ে পারিবারিক উৎসবে নাচ, এসব কারণে বহুবার তার বাবার দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল ওকে অনেকবার। মঞ্চের নেশায় পেয়ে পড়াশুনা ওর কখনও সেভাবে হয়ে উঠেনি। ওর বয়সী ছেলেরা অনার্স, মাস্টার্স শেষ করে অনেকে চাকরীতে ঢুকে গিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে গিয়েছে আর সে বসে ছিল পরিবারের উপর নির্ভরশীল হয়ে। মাঝে মাঝে অনেক রাগ হত, ওকে বলতাম, “তোমার জীবনটা মঞ্চ শেষ করে দিয়েছে। নিজের দিকে একটু দেখ। তোমার সাথের সবাই এমনকি নাটকের দলের ওরাও তাদের আখের গুছিয়ে নিয়েছে আর তুমি এখনও সেই আগের জায়গাতে আছো। তাদের জোগাড় করে দেয়া কিছু ফ্রিল্যান্স কাজ কর আর সেটা দিয়ে তোমার হাত খরচ চলে। বাসায় সেভাবে সাপোর্ট করতে পারো না। সেজন্য তোমাকে কথা শুনতে হয় তোমার দুলাভাইয়ের যিনি কিনা হঠাৎ করে খুব ধার্মিক হয়ে গেলেন। তোমাকে হেদায়েত করার চেষ্টা করতেন তোমার সেক্সুয়ালিটি নিয়ে কটু কথা বলে”। চাকরির চেষ্টা করতো অনেক কিন্তু সে সফল হতে পারেনি। দুর্ভাগ্য ওকে কখনও পিছু ছাড়েনি। শেষের দিকে ওর মা অনেক জোগাড়যন্ত্র করে আশা ইউনিভার্সিটিতে আইন শিক্ষা বিষয়ে অনার্সে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। প্রাইভেট ছিল শেষ ভরসা, পাবলিকে পড়ার বয়স আর সময় আর ছিল না।
১৪ই এপ্রিল, ২০১৬-তে রঙধনু র্যালি করার প্ল্যান ছিল। বিগত কয়েকমাস ধরে বিভিন্ন হেট ম্যাসেজ, জীবননাশের হুমকি উপেক্ষা করেই তনয় আর জুলহাজ ভাই এই পরিকল্পনাতে এগিয়ে যান। সবাই রাজি থাকলেও আমি সেইবার বিপক্ষে ছিলাম রঙধনু র্যালির। কারণ চারপাশ থেকে তখন হুকি গুলোকে আসলেই বাস্তব বলে মনে হচ্ছিল আমার। জুলহাজের সাথে আমার শেষ দেখা পহেলা বৈশাখের আগের সপ্তাহের র্যালির জিনিসপত্রের ডেলিভারি দেয়ার সময়। ১৩ই এপ্রিল রাতে তনয় ফোন করে জানালো র্যালি বাতিল করা হয়েছে প্রশাসনিক বাধার কারণে। কিন্তু তারা যাবে সাধারণ মানুষের সাথে মঙ্গল-শোভা যাত্রার অংশ হয়ে। পরদিন সকালে ঢাকার অনলাইন ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম গুলো শুরু করে রূপবানের ৪ জন কে কর্মী কে শাহবাগ থানাতে আটকের ঘটনা নিয়ে মুখরোচক গল্প ফাঁদা। আমরা যারা ভীতু তারা বাসায় বসে সেগুলা দেখছিলাম। আমজনতার ঘৃণা ভরা মন্তব্য পড়ছিলাম, ভয় পাচ্ছিলাম আর সংবাদ মাধ্যমের নিকুচি করছিলাম। চারজন নিরীহ সেই ছেলেগুলোকে বাঁচানোর জন্য শুধু তনয়সহ আর মাত্র ক’জন ছিল সারাটা দিন শাহবাগ থানাতে, আমারা না।
২০১৬ এর ২৪শে এপ্রিল ওর পঁচিশতম জন্মদিন ছিল। এর আগেরবারে সে দুটা কেক কেটেছিল বলে এবার জেদ ধরল কিছুই করবে না। শুধু আমার সাথে কাটাবে। জুলহাজ ভাই ডেকেছিল একসাথে উদযাপন করতে, ও গেলো না। রেস্টুরেন্টে আমাকে ট্রিট দিল একগাদা খাবার দিয়ে। এরপর আমাদের পছন্দের একটা সুপার শপে গেলাম এমনি ঘুরাঘুরি করতে। ওখান থেকে সে বেলিসিমো ব্র্যান্ডের নতুন একটা আইসক্রিম কেক খেতে চাইলো। এবার এটাই তার জন্মদিনের কেক হবে। বাসায় এসে দেখলাম খুবই বাজে খেতে! সেদিন সে থেকে যেতে বলল আমাকে রাতে। আমি গরমের জন্য থাকতে চাইনি। ও মন খারাপ করল। আমি বললাম আরেকদিন। আজকে ইলেক্ট্রিসিটির অনেক সমস্যা। পরদিন ছিল ওর পরীক্ষা। ভার্সিটি জীবনের প্রথম সেমিস্টারের ফাইনাল। জুলহাজ ভাই আগে থেকে ঠিক করেন উনি আর তনয় ভারতে একটি কনফারেন্স এ যোগ দিবেন। মুম্বাইতে হবে সেটা। ভিসার জন্য তনয় ২৫ তারিখ দেখা করবে তার বাসায়। সেদিন বেলা বারোটার আর কথা হয়নি আমাদের। দুজনের সাথেই যে সেদিনই শেষ কথা হবে সেটা সন্ধ্যা ৬ টার আগে আর বুঝতে পারিনি।
বাংলাদেশী সহ বেশ কয়েকটি বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে তনয়কে দেখানো হল জুলহাজ ভাইয়ের বন্ধু ও একজন নাট্যকর্মী হিসাবে। সেই ধারণা আজও পরিবর্তন হয়নি।
রাগ হতো, অভিমান হতো কিন্তু বাস্তবতা চিন্তা করে চুপ হয়ে গেলাম। তনয়ের পরিবার তাদের সন্তানকে হারিয়েছে। তারা জানেন কেন তারা তাদের ছেলেকে হারিয়েছেন। আমরা হয়তো যুদ্ধ নিয়ে মাতামাতি করছি খুব কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী ধ্বংসযজ্ঞের চিন্তা করিনি। সমাজ এখন তাদের দিকে আঙ্গুল তুলে কথা বলে। প্রতিবেশী আর আত্মীয় স্বজনদের চোখে তনয় হচ্ছে একজন নাস্তিক তাই নাকি তাকে হত্যা করেছে জঙ্গিরা। ভাবতে পারি না আসলেই ওর পরিবারকে কিভাবে এখন দিন যাপন করতে হচ্ছে।
তনয় চেয়েছিল মানুষ একটা সময় আমাদের বুঝতে পারবে, আমাদের আবেগের মূল্য দিবে। আমরা যে সাধারণ মানুষের চেয়ে কম নই সেটা সমাজ বুঝতে পারবে। এই জন্য কখনই সে নিজের পরিচয় লুকায়নি পরিবার বা কাজের ক্ষেত্রে। সে অনেক ধর্মভীরু ছিল। ধর্ম মতেই সে মনে করতো আমাদের হয়তো পরপারে দোষী সাব্যস্ত করা হবে আর দোজখেই আমাদের স্থান হবে। তারপরও সে চেয়েছিল বাঁচলে বাঁচার মতন করে বাঁচবে। সে চাইতো সবাই তাকে তার আসল পরিচয়ে জানবে। মাঝে মাঝে ওকে প্রশ্ন করতাম, তোমার কি মনে হয় তোমার এই খোলস না ধরার কারণে তোমার নাটকে বা টিভিতে ক্যারিয়ার হয়ে উঠেনি তেমনভাবে? সে উত্তর দিত না। অর্থহীন ভাবে মুচকি হাসত। সেই হাসির কোন মানে আমি কখনো বুঝে উঠতে পারিনি।