জুলহাজ মান্নান। নামটা সামনে আসলেই একজন মানুষের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠে। একজন মানুষ, যার সাথে আমার সম্পর্কটার কোন নাম আমি কখনোই দিতে পারি নি। ভালোলাগা, বন্ধুত্ব, দায়িত্ববোধ, শ্রদ্ধা সবকিছু ছিল সেখানে। সর্বোপরি আমাদের সম্পর্কের একটা ভাষা ছিল। ঠিক কবে, কিভাবে মানুষটা আমার দিক নির্দেশক  হয়ে উঠল, আমার মনে পড়ে না। তবে তার সাথে প্রথম পরিচয়ের কথা ভুলে যাবার নয়। ২ অগাস্ট, ২০০৫। আমাদের প্রথম দেখা। সংসদ ভবন এলাকায়। ফতুয়া আর জিন্স পড়া হ্যাংলা পাতলা একজন মানুষ। কথায় কথায় কখন যে সন্ধ্যা পেড়িয়ে গিয়েছিল। তার বাচন ভঙ্গি, নানান বিষয়ে জ্ঞান, প্রাণোচ্ছল হাসি, কোন সামান্য ঘটনাকে অভিনয় করে অনেক মজার করে তুলে ধরা; বিশেষ করে “ হাই দাইয়া!বাস ভি কারো! লোক ক্যা কাহেঙ্গে?” ইয়াহু চ্যাটের খুব মজার এক ইমো চরিত্রকে নিয়ে সে যে মিমিক্রি করতো, এসব খুব সহজেই আমাকে আকর্ষণ করেছিল।

ঢাকা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে, কখনো ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে কতটা দিন আমরা আড্ডা দিয়েছি তার ইয়ত্তা নাই। ঢাকা শহরের সবকিছু নতুন ছিল আমার কাছে। জুলহাজ ভাই চিনিয়েছিল সব। কোন রেস্টুরেন্টের বিরিয়ানি ভালো, কোন বেকারির কেক ভালো অথবা কোথায় ভালো চটপটি পাওয়া যায়, সব যেন তার নখদর্পণে ছিল। শাহবাগ থেকে জুলহাজ ভাই মাঝে মাঝেই একগাদা করে ফুল কিনতো। আমি অবাক হয়ে যেতাম। কারণ সে অনেক বেছে বেছে বাঁকা বাঁকা ডাটা যুক্ত ফুল কিনত। সে জার্বেরাই হোক, আর গ্লাডিওলাসই হোক। আমার অবাক তাকিয়ে থাকার কারণ বুঝে মাঝে মাঝে ছলনার হাসি দিত। বাসায় যাবার পর যখন ফুলগুলো স্বচ্ছ কাঁচের জারে সেগুলো সাজাতো, আমি তার ছলনার হাসির কারণ বুঝতে পারতাম। তখন ফুলগুলো যেন নতুন এক রূপ পেত। এরকম হাজারো স্মৃতি আছে তার সাথে। খুব ছোট ছোট স্মৃতি হলেও তার শিল্পী মনের পরিচয় আমাকে তার ব্যাপারে মনযোগী করে তুলেছিল বার বার। মাঝে মাঝে অনেক ঈর্ষা হতো। মনে হতো, ইস আমি যদি তার মতো হতে পারতাম।

জুলহাজ ভাইয়ের আইআর এর কিছু বন্ধুর সাথে সেসময় প্রচণ্ড ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল আমার। একসাথে কত যে সুন্দর সময় পার  করেছি, বলে বুঝানো সম্ভব নয়।

সবার মধ্যমণি জুলহাজ ভাই। প্রাণোচ্ছল একজন মানুষ। কারো মন খারাপ, কারো মন ভীষণ ভালো, সেই অনুভূতিগুলো অনায়েসে জুলহাজ ভাইয়ের সাথে শেয়ার করতে দেখেছি আমি।

ধানমণ্ডি ৩২ এর বজরা ছিল প্রতি সন্ধ্যার আড্ডাখানা। কে কখন কি খাচ্ছে, কে কখন খাবার বিল দিচ্ছে, সে এক দেখার মত ব্যাপার ছিল। রাত বেশি হয়ে গেলে আমি জুলহাজ ভাইয়ের বাসায় চলে যেতাম। ওদের শ্যামলীর বাসায়। এত রাতে চুপিচুপি দরজা খুলে, কোন শব্দ না করে দুজন এক দৌড়ে চলে যেতাম শোবার ঘরে। কখনো এরকম হয়েছে, আমরা দৌড় দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছি আর তখন দেখা গেলো লিভিং রুমে আংকেল বা অ্যান্টি বসে আছেন। সেদিন শোবার রুমের দরজা বন্ধ করে আমরা দুজন প্রচণ্ড হাসতাম। জুলহাজ ভাইয়ের বাসায় যাব, আর চকলেট কেক খাবো না, তা হতো না কখনো। এ যেন একধরণের আবদার হয়ে গিয়েছিল। তার আর আমার পারিবারিক নামের প্রচণ্ড রকম মিল কে কেন্দ্র করে অনেক মজার ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি বহুবার।

আমার জীবনে বাবা-মাকে ছাড়া প্রথম জন্মদিন আমি পালন করি জুলহাজ ভাইয়ের সাথে। অন্যভাবে বলতে গেলে, জুলহাজ ভাই আমাকে মনে রাখার মত একটি দিন উপহার দিয়েছিল। সেদিন ২ ডিসেম্বর, ২০০৫। আমার বাসায় খুব সকালে এসে উপস্থিত হয়েছিল, সাথে অনেক ফুল আর চকলেট কেক। তার সেদিন অনেক প্ল্যান। আমরা রিক্সা নিয়ে টিএসসি এলাকায় অনেক ঘুরেছিলাম সেদিন। বিকেলে কি এক সারপ্রাইজ আছে, জানিয়েছিল আগেই। বিকেলে আমরা গ্রিন রোডের একটা রেস্টুরেন্ট “জলি বি”তে গেলাম। জানলাম সেখানে বয়েজ অব বাংলাদেশ (বব) এর ফিল্মশো হবে। জেনে আমি চরমভাবে পুলকিত হয়েছিলাম। কারণ এটা ছিল আমার জীবনের প্রথম বব এর কোন প্রোগ্রাম। তাকিয়েছিলাম তার দিকে। তার ঠোঁটে ছিল ছলনার হাসি। আমি জড়িয়ে ধরেছিলাম আনন্দে। রেস্টুরেন্টের ভিতরের দিকে সকল আয়োজন করা হয়েছিল। ববের তৎকালীন ভলেনটিয়ার দের সাথে পরিচয় হয়েছিল সেদিন প্রথম। দেখেছিলাম “দ্যা ট্রিপ” মুভিটি। মুভি শেষে হঠাৎ শুনতে পেলাম আমার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে ঘোষণা জানানো হল। আমি হতবাক হয়ে তাকালাম জুলহাজ ভাইয়ের দিকে। তার ঠোঁটে তখনো ছলনার হাসি।

এভাবে জীবন পথে চলতে চলতে কেটে গেছে অনেকটা সময়। একসময় আমি পুরাদস্তুর ঢাকাবাসী হয়ে গেলাম। ঢাকা শহরের অলি-গলি চিনতে লাগলাম। কিন্তু জুলহাজ ভাইয়ের সেই দ্বিধাহীন সঙ্গ খুব মিস করতাম। তার খুব সুন্দর করে, গুছিয়ে বুঝানোর যে ক্ষমতা আমি দেখেছি, সেই অভিজ্ঞতাকে মিস করতাম। দুজন দুজনের মত করে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু যোগাযোগের আরও অনেক মাধ্যম আমাদের মাঝে তৈরি হয়েছিল। এই একটা মানুষ যার কাছে সম্পর্কের যে নতুন সংজ্ঞা আমি জেনেছিলাম, আজও আমি তা বহন করে চলেছি। তার “না” বলার ক্ষমতা যেমন অসাধারণ ছিল, তেমনি অঙ্গীকারের জায়গাটা ও ছিল অনেক স্বচ্ছ।

আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে যেমন তাকে পাশে পেয়েছি, তেমনি চেষ্টা করেছি তাকে তার যথাযথ সম্মানটুকু দিতে। যাদের সাথে কাজ করেছি সবসময়, আমার গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে তাদের অনেক সময় পাশে পাইনি। কিন্তু সেই মানুষটি সবকিছুর ঊর্ধ্বে থেকে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, আমাকে যেমন শুভেচ্ছা জানিয়েছে, তেমনি সচেতন করেছে। এরকম একজন মানুষকে ভালো না বেসে কি কোন উপায় আছে? জুলহাজ ভাই আমার বাসায় আসবে, আর তার জন্য “চা” প্রস্তুত থাকবে না, এটা হতো না। আবার তার লিভিং রুমের সিরামিক ব্রিক আর আমার বাসার সিরামিক ব্রিক একই রকম; বিধায় আমি তার ডিজাইন চুরি করেছি বলে আমাদের দুইজনের যে খুনসুটি- আমার প্রতি তার এক অদেখা দাবি, বা তার প্রতি আমার এক অদেখা আবদার, এ যেন এক মিষ্টি- মধুর ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল।

তার জীবনের শেষদিনটিতে এসে তার পাশে দাঁড়াতে না পারার যে গ্লানি, এটা আমাকে সারাটা জীবন তাড়া করে ফিরবে। আমি  জানি, তাকে ঘিরে আমার প্রচণ্ড ভালো লাগার যে জায়গাটা; সেটা কখনও কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আমি জুলহাজ ভাই কে বলেছিলাম, আমার ওয়াটার গার্ডেনে যেদিন শাপলা ফুল ফুটবে, সেদিন আমি ফেসবুকে ছবি দেব। সাথে লিখে দেব “ইন্সপায়ার্ড বাই জুলহাজ মান্নান।” আমার সে দিনটি আর আসেনি…