আজ এই রঙ্গিন বসন্তে কিছু স্মৃতি ফিকে হয়ে যাচ্ছে আর কিছু দগদগে রক্তাক্ত ক্ষতের মত পীড়া দিচ্ছে৷ আজ প্রায় একবছর হতে চললো৷ গত বছর ঠিক এই বসন্তে মার্চের ১৭ তারিখেই হয়েছিল “রূপবান ইয়ুথ লিডারশীপ ট্রেনিং প্রোগ্রাম”৷ খুলনা হতে কেবল আমিই গিয়েছিলাম সেখানে৷ যদিও অনেকেই যেতে চেয়েছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে নানা সমস্যার অজুহাত দেখিয়ে কেউই গেল না৷ যেটা হয় আরকি, বাঙালীর তিন হাত; ডান হাত, বাম হাত আর অজুহাত৷ সে যা হোক, আমি এই ইভেন্টে অংশগ্রহণ করতে পেরে নিজেকে বেশ ভাগ্যবান মনে করি৷ জুলহাজ ভাই আর রূপবানের অনেকের সাথে দেখা হয়ে যায়৷ তাঁরা সাদরে আমাকে অভ্যর্থনা জানান৷ অনেক নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হয়ে যায়৷ বাংলাদেশের নানা প্রান্তের বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্বও হয়ে যায় খুব অল্প সময়ে৷ সেশনগুলি খুব ভালই চলছিল৷ একটি সেশনে তনয় ভাইকে দেখা গেল অর্ধ-নর আর অর্ধ-নারী রূপে৷ তোমরা যদি কখনো বহুরূপী কি তা না দেখে থাকো, তাহলে বুঝবে না যে একই অঙ্গে কত যে রূপ আর ব্যক্তিত্ব থাকতে পারে৷ তনয় ভাই মানুষটিও তেমনই ছিলেন৷ দুর্গার যেমন দশ হাত, তনয় ভাইয়েরও তেমনি দশ রূপ! যে কোন কিছুর অভিনয়, যে কোন চরিত্রে অভিনয়ে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন তিনি৷ শখ ছিল, আমার প্রাণসখার হাত ধরে বেইলি রোডে যাব তনয় ভাইয়ের “সোনাই মাধব” দেখব, থিয়েটারে৷ সে শখ আমার আর পূরণ হলো না!
যে কোন চরিত্রের গভীরে প্রবেশ করে সেটিকে বাস্তবে রূপদান করার সুনিপুণ দক্ষতা ছিল তাঁর৷ আমি যখন প্রথম তাঁর সাথে কথা বলি, তখন তাঁর অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিলাম৷ আমার লেখা কবিতার আবৃত্তি করেছিলেন তিনি৷ কবিতার নাম ছিল “শিখণ্ডীর অনুযোগ”৷ পরবর্তীতে তা মঞ্চস্থ করেছিলেন তিনি৷ মঞ্চায়নের সময় একজন প্রকৃত “শিখণ্ডী”-র রূপ ধারণ করেছিলেন তনয় ভাই৷ আবেগ আর অভিনয় দক্ষতার মাধ্যমে উপস্থিত দর্শক – শ্রোতাদের হৃদয়ে দাগ কেটেছিলেন আর তাঁদেরকে কাঁদিয়েছিলেন তনয় ভাই৷ আমার লেখা সাধারণ কবিতা তাঁর স্পর্শে হয়ে উঠলো “অসাধারণ”, এ যেন “মাইডাসের স্পর্শ”৷
সত্যিই জুলহাজ ভাই, তনয় ভাই আর রূপবানের সকল সদস্যবৃন্দ খুবই জ্ঞানী, গুণী আর প্রতিভাবান মানুষ৷ তাঁদের অনুপ্রেরণায় আমি নিজেকে আবিষ্কার করতে শিখেছি৷ তাঁদের অবদান আমি কখনই ভুলতে পারবো না৷
আজ তাই অনেকদিন বাদে, ভৈরব তীরের এই নির্জন স্থানে বসে প্রকৃতির মাঝে আমি তাঁদের বিদেহী আত্মাদেরকে অন্বেষণ করছি আর স্মৃতির পাতা হাতড়াচ্ছি৷ যেমনটি কবি জীবনানন্দ বলেছেন;
আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শংখচিল শালিখের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।
হয়তো বা হাঁস হব- কিশোরীর- ঘুঙুর রহিবে লাল পায়
সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে।
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এই সবুজ করুণ ডাঙ্গায়।হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে।
হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমূলের ডালে।
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে।
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙ্গা বায়; রাঙ্গা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।
ভৈরবের তীরে তাই জুলহাজ ভাই আর তনয় ভাইকে খুঁজছিলাম বক আর শালিক পাখির দলে৷ এখানে পলাশ-শিমুল-মান্দার-অশোক ফুটে লালে লাল! বসন্তের কোকিল যেমন আগে ছিল, এখনও আছে ভবিষ্যতেও থাকবে হয়তো৷ কিন্তু ঋতুরাজই যদি না আসে তাহলে কোকিলদের অস্তিত্ব থাকবে কি? অনেকেরই বসন্ত আজ রঙ্গিন, আর আমার বসন্ত ধূসর!