বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে যৌনতা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা এখনো একটি সামাজিক ট্যাবু। এর মাঝে উভকামিতা (Bisexuality)এমন একটি পরিচয়, যা শুধু উপেক্ষিত নয়, প্রায়শই ভুল ব্যাখ্যা ও হেয় প্রতিপন্ন হয়। অথচ এটা আমাদের সমাজে নতুন কিছু নয়—বরং লুকিয়ে থাকা চেনা বাস্তবতা।

উভকামিতা হলো এমন একটি যৌন অভিযোজন, যেখানে একজন ব্যক্তি নারী ও পুরুষ উভয়ের প্রতিই যৌন ও মানসিকভাবে আকৃষ্ট হন। এটি কোনো বিকৃতি নয়, কিংবা “ফ্যাশনের জন্য বানানো পরিচয়” নয়—এটি একটি প্রাকৃতিক ও স্বীকৃত যৌন বৈচিত্র্য

১৮৫৯ সালে রবার্ট বেন্টলি টড প্রথমবারের মতো ‘উভলিঙ্গতা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে বিজ্ঞানী হেনরি হ্যাভলক এলিস ও ক্রাফ্ট-ইবিং যৌনতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন এবং দেখান, মানব জীবনের প্রাথমিক স্তরে লিঙ্গ পৃথক করা যায় না—একটি যৌনভাবে ফ্লুইড বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে।

  • ডিন হ্যামার-এর গবেষণায় দেখা গেছে, X ক্রোমোজোমের একটি নির্দিষ্ট অংশ (Xq28) পুরুষ সমকামিতার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে।

  • SLITRK6 নামে একটি জিন, মস্তিষ্কের ডায়েনসেফালন নামক অংশে সক্রিয় থাকে, যা সমকামী ও বিষমকামীদের মধ্যে আকারে ভিন্ন।

  • প্রাণীদের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে—টেস্টোস্টেরনের মাত্রা গর্ভাবস্থায় উভকামিতা ও সমকামিতার সম্ভাবনা বাড়াতে পারে।

এছাড়াও “Big Brother Effect” নামে পরিচিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বড় ভাই থাকা ছেলেদের মধ্যে সমকামিতার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি।

এই গবেষণাগুলো প্রমাণ করে, যৌন অভিযোজন একটি জৈবিক ও হরমোন-নির্ভর বৈশিষ্ট্য, যা মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।

বাংলাদেশে এখনো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে উভকামিতা বা সমকামিতা ব্যভিচার বলে বিবেচিত, যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। এই ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সামাজিক হুমকির কারণে অনেকেই নিজেকে গোপন রাখেন, ‘closeted’ অবস্থায় থাকেন।

কিন্তু প্রশ্ন হলো—যে ব্যক্তি কারও ক্ষতি না করে শুধু নিজের ভালোবাসা খুঁজে নিতে চায়, সে কীভাবে অপরাধী হতে পারে?

আজ বিশ্বের অনেক দেশ—যেমন: যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস—উভকামী ও এলজিবিটি জনগোষ্ঠীকে আইনত স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের অধিকার রক্ষা করছে, শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা এবং বিবাহের স্বাধীনতা দিচ্ছে।

এই পরিবর্তন এসেছে শিক্ষা, সচেতনতা এবং মানবিক মূল্যবোধ-এর কারণে।

উভকামিতা কোনো মানসিক সমস্যা নয়, এটি মানুষের জেনেটিক এবং হরমোনগত বৈশিষ্ট্য। তাই এখন সময় এসেছে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সামাজিক কুসংস্কার ভেঙে, এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর। যৌনতা প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার—এটা কেড়ে নেওয়া অন্যায়।

মানবতা কেবল তখনই পূর্ণতা পায়, যখন তা সকল বৈচিত্র্যকে আপন করে নেয়।