সেক্স শব্দটা শুনলেই এখন বাংলাদেশের মানুষ ইতস্ততা বোধ করেন। এখন পর্যন্ত এই শব্দটা সম্পর্কে লুকোচুরি, কানাঘুষা অনবরত চলতেই থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই শব্দটা শুনলেই মানুষ লজ্জা পায় এবং এই বিষয়ে ভয়ে কথা বল্যতে চায় না। যৌন শিক্ষার কথা বলতে গেলে বা খোলামেলা আলাপ চারিতা করতে শুরু করলে লোকজন সেখান থেকে সরে যায় বা ধমক দিয়ে এই বিষয়ে কথা বলতে বারণ করেন। অথচ মানুষ বুঝতে চায় না, যে বিষয়ে যত বেশি কথা বলা হবে, বা জানা যাবে মানুষ এসকল বিষয় বুঝতে শিখবে এবং অপরাধের পরিমাণ কমে যাবে।
যৌনপ্রবৃত্তি বলতে বোঝায় পুরুষ, নারী, উভয়লিঙ্গের প্রতি পারস্পরিক আবেগ, প্রণয় এবং অথবা যৌনআকর্ষণজনিত এক স্থায়ী সম্পর্কাবস্থা। এ প্রবৃত্তির একটি প্রান্তে কেউ কেউ শুধুমাত্র বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, আর অপর প্রান্তে কেউ কেউ শুধুমাত্র সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। তবে সাধারণত যৌনপ্রবৃত্তিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়: বিপরীতকামিতা (বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ), সমকামিতা (সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ) এবং উভকামিতা (উভয় লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ)।
একজন ব্যক্তি কীভাবে বুঝবে সে সমকামী বা উভকামী? যখন জানবার তখনই জানা যাবে। এটা জানতে কিছুটা সময় লাগতে পারে এবং এ জন্য তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। মূল আকর্ষণটি প্রাপ্তবয়ষ্কদের যৌনপ্রবৃত্তির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এবং সেটা সাধারণত শিশুকালের মধ্যবর্তী সময় থেকে শুরু করে কৈশোরের শুরুর দিক থেকেই অনুভূত হয়।
এখানে বলা যায় যে, ভিন্ন ভিন্ন সমকামী বা উভকামীদের ক্ষেত্রে তাদের যৌনপ্রবৃত্তির বিষয়ে বেশ ভিন্নরকম অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। কোনো কোনো মানুষ কারও সঙ্গে প্রকৃত সম্পর্ক স্থাপনের অনেক আগে থেকেই বুঝতে পারেন যে তারা সমকামী ও উভকামী। কেউ কেউ তাদের যৌনপ্রবৃত্তি জানবার বা বুঝবার আগেই অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করে। আবার কোনো কোনো মানুষ নিজেদের যৌনপ্রবৃত্তি সম্পর্কে প্রকৃতপক্ষে সুনির্দিষ্টভাবে না জেনেই যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হয়।
এখানে একটা কথা বলতে হয় যে, সংস্কার ও বৈষম্যের ফলে অনেকের পক্ষেই নিজেদের যৌনপ্রবৃত্তি ও পরিচিতি তুলে ধরা বা প্রকাশ করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। তারা বলতে পারে না যে, তারা সমকামী বা উভকামী। ফলে তাদের প্রকৃত পরিচিতি প্রকাশিত হওয়ার বিষয়টি বিলম্বিত বা সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়ে।
কী কারণে একেকজন ব্যক্তির যৌনপ্রবৃত্তি একেক রকম হয়? বিজ্ঞানীরা কখনওই একমত হয়ে বলতে পারেননি যে, কী কারণে একজন ব্যক্তি বিপরীতকামী, সমকামী এবং উভকামী হয়ে থাকে বা ওইসব যৌনপ্রবৃত্তি ধারণ করে থাকে। অনেকেই মনে করেন যে, এ ক্ষেত্রে প্রকৃতি ও পরিবেশ উভয়েই একটি জটিল ভূমিকা পালন করে থাকে। মানুষ তাদের ত্বকের রং যেমন বাছাই করতে পারে না, ঠিক তেমনি যৌনপ্রবৃত্তি নির্ধারণ করার ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা সীমিত।
সংস্কার ও বৈষম্য বিপরীতকামী, সমকামী এবং উভকামী মানুষদের ক্ষেত্রে কী ভূমিকা পালন করে
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যে সকল সমকামী বা উভকামী ব্যক্তি প্রকাশ্যে নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকে, তারা অনেকই সংস্কারজনিত ঘৃণা, বৈষম্যমূলক আচরণ এবং সহিংসতার শিকার হয়ে থাকে। অনেকেই তাদের স্কুলে, বিশ্ববিদ্যালযে এবং কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়। তাদের স্বাস্থ্যসেবা ও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং পরিবারের সদস্য ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে তেমন সমর্থন পায় না।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের রেখে যাওয়া ১৮৬০ সালে প্রণীত দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা অনুসারে একই লিঙ্গের দুজন মানুষের যৌনসঙ্গম যাবজ্জীবন কারাদণ্ডযোগ্য অপরাধ। এর ফলে খুব কমসংখ্যক মানুষই তাদের যৌনপ্রবৃত্তির কথা প্রকাশ করে থাকে বা করতে পারে। এর ফলে অধিকাংশ মানুষই গোপনীয়তা ও মিথ্যার জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়। এতে তাদের জীবনাচরণ নৈতিকতাবিরুদ্ধ হয় এবং গোঁড়ামির শিকার হয়।
বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে বিয়ে নারীদের জন্য নির্বাণপ্রাপ্তি বলে ধরে নেওয়া হয়। তাই নারী সমকামীদের ক্ষেত্রে সমাজে সহনশীলতার মাত্রা একেবারেই কম।
সংস্কার ও বৈষম্য একজন ব্যক্তির মানসিক অবস্থার ওপর কী প্রভাব ফেলে? সমকামভীতি বাংলাদেশে ব্যাপক আকার ধারণ করে আছে এবং তা সমকামীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও ভালো থাকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে যখন তা তাদের যৌনপ্রবৃত্তি গোপন রাখতে বা তাকে অস্বীকার করতে বাধ্য করে। সংস্কার, বৈষম্য ও সহিংসতা সমকামীদের ওপর প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান মজুমদার ও অন্যান্যদের এক গবেষণায় দেখা যায় যে, বাংলাদেশের শতকরা ৪৭ ভাগ ‘সমকামী পুরুষ’ অন্তত একবার আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছে।
কিন্তু আত্মহত্যা এর সমাধান হতে যাবে কেন? আমার মতো যারা উভয়কামি মানুষ আছেন আমরাও সাধারণ মানুষদের মতোই মানুষ। কোন মানুষের যৌনাকাঙ্ক্ষা দিয়ে সেই মানুষকে বিচার করা কি আপনাদের ঠিক হচ্ছে? আমাদের মওত মানুষদের বছাত দূরে থাক আমাদের ধারে কাছে আস্তে ছান না আপনারা। আমাদেরকে অভিশপ্ত মণে করেন, কিন্তু কেন? এমন হবার কথা ছিল না। আমাদের কয়ে অভিশপ্ত মণে করার কোন যৌক্তিক কারণ আছে কি আপনাদের কাছে? যদি নাই থাকে তাহলে কেন এই অবিচার?