আন্দোলন কথাটি অনেক বড় অর্থ ধারণ করে। সারা পৃথিবীতেই নারী আন্দোলনের বিষয়ে অনেক কাজ হয়েছে। বাংলাদেশেও নারী আন্দোলনের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। বাংলার সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতিতে নারীর সাহসিকতার মূর্ত প্রকাশ ঘটেছে। রাজনীতির ক্ষেত্রেও নারীর ভূমিকা অতুলনীয়। সারা বিশ্বে নারী আন্দোলনের যে ধারা, তার স্রোত সে-ই ব্রিটিশ আমল থেকেই এই অঞ্চলের নারীদের মাঝে সঞ্চারিত হয়।
আঠারো থেকে বিশ শতক পর্যন্ত বাঙালি নারীর অধিকার সচেতনতা ও আন্দোলনের ইতিহাস এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক উত্থান-পতন ও ভাঙা-গড়ার ইতিহাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। নারী আন্দোলনের পিছনে প্রাথমিক যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কাজ করেছে, তা হল দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি।
যেদিন থেকে নারী তার মানবসত্তাকে আবিষ্কার করেছে, মানুষ হিসেবে নিজের অর্জন ও ত্যাগের খতিয়ান নিজেই লিখতে শুরু করেছে, সেদিন থেকে নারী আন্দোলন আসলে মানবসমাজের আন্দোলনের সঙ্গে মিলে গেছে। রাজশাহীর রানী ভবানী, ঝাসীর রানী লক্ষ্মীবাঈ বা চট্টগ্রামের প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখের কথা যখন আমরা বলি, তখন মূলত মানুষের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেয়া জীবন উৎসর্গোকারী একজন মানুষের কথাই বলি।
পাকিস্তানের তেইশ বছরের শাসন বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাংলার নারীসমাজ সোচ্চার প্রতিবাদ জারি রেখেছিলেন নিষ্ঠা আর সততার সঙ্গে। বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পুরো ধারাতেই বাংলার নারীদের অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা আন্দোলন যে আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় নির্ধারণেরও আন্দোলন, এই সত্য তৎকালীন নারীসমাজ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। ফলে কেবল ঢাকা শহরেই নয়, ভাষা আন্দোলনে সারা বাংলায় নারীদের অংশগ্রহণ ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্তে বাংলার নারীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং পুলিশের লাঠিতে অনেকে আহত হন। এদের মধ্যে রওশন আরা বাচ্চু, সুফিয়া আহমদ, হালিমা খাতুন, সারা তৈফুর, শামসুন্নাহার ও ড.শরীফা খাতুন প্রমুখ অন্যতম। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিমদের সংরক্ষিত ৯টি নারী আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নূরজাহান মুরশিদ, সেলিনা বানু, শামসুন্ নাহার মাহমুদ, বদরুন নেসা আহম্মেদ, দৌলতুন নেসা খাতুন, রাজিয়া বানু, তফতুন্নেসা, মেহেরুন নেসা জয়ী হন। এই জয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল তৎকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসে।
১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনেও নারীর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। শরীফ শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন ছিলো চরমভাবে গণ-বিরোধী কিন্তু তার দুই বছর বাদে দেয়া হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন ছিলো অপেক্ষাকৃত উন্নত। কিন্তু কোনোটিতেই নারীশিক্ষার ব্যাপারে মৌলিক অগ্রগতির নির্দেশনা ছিলো না।  এই নারীবিরোধী শিক্ষাব্যবস্থার প্রস্তাবনার বিরুদ্ধে নারীদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে পরিচালিত ছাত্র আন্দোলনে ইডেন কলেজছাত্রী সংসদের তৎকালীন ভিপি ও ছাত্র ইউনিয়নের শীর্ষ নেত্রী মতিয়া চৌধুরী এবং আরেক নেত্রী নাজমা বেগম শক্ত অবস্থান নিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি নারীর যে অবদান, তা লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। যদিও ইতিহাস কেবল নারীর নির্যাতিত হবার বিষয়টিই  উঠে আসে বারবার অথচ রণাঙ্গনে-ঘরে-বাইরে নানা গুরুত্বপূর্ণ ও অসীম সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করেছেন নারীরা। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মশাল জ্বেলে যেমন তারা গেয়েছেন মুক্তির গান, তেমনই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সৃষ্টি করেছেন প্রেরণার আহ্বান।  প্রায় সাড়ে চার লক্ষ নারী নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হবার  যেসব নারী নির্মম হিংস্র নির্যাতন সহ্য করেছেন মাতৃভূমির জন্যে,স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তাদেরকেই অছ্যুৎ মনে করা হয়। এই সামাজিক বিপর্যয় আরও তীব্র হয় যখন একের পর এক যুদ্ধশিশুর জন্ম হতে থাকে। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথেও তখন আমরা একজন নীলিমা ইব্রাহীমকে পাই।
সময়ের সাথে সাথে নারীশিক্ষার হার বাড়তে থাকে, নারীদের অর্থনৈতিক গতিশীলতা তৈরি হতে থাকে ঠিকই, কিন্তু নারীর ওপর নেমে আসে নানাবিধ নিপীড়ন। ফলে নারীর আন্দোলন কেবল আর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থাকে না, এটি রূপ নেয় বহুধা বিভক্ত শ্রেণি-সংগ্রামের ধারায়।
নারীর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলন স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। সমাজে একটি মানসিকতার তৈরি হয়েছে যে, নিপীড়ন বন্ধ করতে পুরুষকেই সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকাটি পালন করতে হবে।
ধর্মের নামে নারীকে ঘরে বন্দি করে রাখতে চায় এবং নারীর বিরুদ্ধে মধ্যযুগীয় ফতোয়া দেয়। রাজনীতির এ সমীকরণ বেশ নাম করেছে সাম্প্রতিক সময়ে। প্রগতিশীলতার মোড়কে যখন মৌলবাদকে তোষণ করছে রাষ্ট্র, তখন আসলে দেখার সময় এসেছে আমাদের নারী আন্দোলন কোন পরিস্থিতিতে আছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি এবং তা আদায়ে শহীদ জননীর আন্দোলন থেকে শুরু করে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন– পুরো বিষয়টিতে নারীর অংশগ্রহণ সম্ভবত স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো নারী আন্দোলনের নিদর্শন।
আজকের নারী আন্দোলনের সবচেয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তনটি এসেছে অনলাইনের কারণে। নারী সমাজের নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বা রাষ্ট্রের সমাজের নানা অসংগতিগুলো আজ ব্লগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র উচ্চারিত-উত্থাপিত হচ্ছে। ফলে মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়ছে। এই জনসম্পৃক্ততার নতুন তত্ত্ব নিশ্চিতভাবেই আমাদের ভবিষ্যৎকে নির্মাণ করবে আমাদের আদর্শের আলোকেই।