মধ্যপ্রাচ্য থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রতিনিয়তই দেশে ফিরছেন ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় যাওয়া বাংলাদেশি নারীরা।
বারবার এই সংকট নিরসনের কথা বলার পরও মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ হচ্ছে না। সৌদি আরব, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরও বৈধ ও অবৈধ উভয় পথেই নারী শ্রমিকরা যাচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যে। এমনকি নিষিদ্ধ লিবিয়া ও সিরিয়াতেও যাচ্ছেন নারী শ্রমিকরা। এই নির্যাতনের মাত্রাও দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। আর এই নির্যাতনের মাত্রাও বাড়ছে দিনকে দিন। একারণে আগেই মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে ফিলিপাইন,ইন্দোনেশিয়া,নেপাল ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো। এখন সময় এসেছে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কঠোরভাবে বাস্তবায়নের।
উন্নত জীবনের আশায় প্রতি বছরই পরিবার ও পরিজন ছেড়ে মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি নারী শ্রমিক। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর খপ্পরে পড়ে তারা একদিকে যেমন হন সর্বস্বান্ত তেমনি অন্যদিকে সহ্য করেন নরক যন্ত্রণা। বিভিন্নসূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, গৃহশ্রমিক, নার্স, পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজের জন্য আকর্ষণীয় বেতন দেওয়ার লোভ দেখিয়ে নারীদের মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাওয়া হলেও তাদের মূলত দেহ ব্যবসায় বাধ্য করা হচ্ছে। এমনকি সেসব দেশের গৃহকর্তারাও বাংলাদেশি নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন চালাচ্ছেন।
প্রতিবাদ করলেই নারী শ্রমিকদের ওপর নেমে আসে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন। জানা গেছে বেতন না দিয়েই দিনের পর দিন তাদের অভুক্ত পর্যন্ত রাখা হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের কথা বললেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীরা প্রবাসে ভালো আছেন কিনা তা তদারকির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থাই নেই। অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা একাধিক সংগঠন ও সংশ্লিষ্ট সংসদীয় ককাস বলেছে, সরকার ও রিক্রুটিং এজেন্সির দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি না বাড়ালে এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে না।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশে ৭ লাখ ৩৫ হাজার ৫৭৫ জন নারীকর্মী পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই গেছেন প্রায় দুই লাখ ৩৪ হাজার ৮৩১ জন। ২০১১ সালের দিকে বাংলাদেশ থেকে বিনা খরচে নারীকর্মী নেওয়ার প্রস্তাব দেয় দেশটি।  ঐসময়ে মাসিক মাত্র ৮০০ রিয়াল বা ১৬ হাজার টাকা বেতনে ২০১৫ সালে গৃহকর্মী পাঠাতে রাজি হয় বাংলাদেশ।
নারীরা সাপ্তাহিক ছুটি পাবেন, বিশ্রামের আলাদা জায়গা পাবেন, তারা দেশে যোগাযোগের জন্য মোবাইল ফোন পাবেন এমনকি সৌদিতে বীমা হবে তাদের নামে এমনটি বলা হয়ে থাকলেও বাস্তবচিত্রে এর ভিন্নতা দেখা যায়। একারণে অনেক নারীরা পালিয়ে দেশে ফেরেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া গেছে মূলত নয়টি কারণে চুক্তি শেষ হওয়ার আগেই নারীশ্রমিকরা দেশে ফিরে আসেন। এই কারণগুলো হলো— হোম সিকনেস, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা সমস্যা, যোগাযোগে সমস্যা, শারীরিক ফিটনেসের অভাব, কাজের অতিরিক্ত চাপ, একের অধিক বাড়িতে কাজ, মৌখিক নির্যাতন ও শারীরিক নির্যাতন। ফিরে আসা নারীদের থেকেই জানা যায় তাদের মধ্যে অনেকেই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অনেকেই ঠিকমতো খাবার পাননি। মারধরের শিকার হয়েছেন। বিপদে পড়লেও তারা দূতাবাসের সাহায্য নেননি বরং পালিয়ে সেফ হোম বা আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসেন। তখন মালিকপক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। দেশে ফিরেও তারা রিক্রুটিং এজেন্সি বা দালালদের বিরুদ্ধেও কোন অভিযোগ করেন না।
বাংলাদেশ সরকারের উচিত সৌদি আরব থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে নারী গৃহকর্মীদের ফিরিয়ে নিয়ে এসে ধীরে ধীরে দেশেই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। যাতে করে একদিকে যেমন এসব আর্তনাদ কমে আসে তেমনি অপরদিকে দেশীয় কর্মসংস্থানে এসব নারীরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতেও পারবেন। অভাবের তাড়নায় দেশ-পরিবার ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমানো নারীরা কেবলই রেমিট্যান্স মেশিন বা পরিসংখ্যানই শুধু নয়। তারা আমাদেরই একজন।