বাংলাদেশের ইসলামিক নেতারা অর্থাৎ যারা মৌলবাদী তারা কোন ধরনের
পরিবর্তনকে এটি ভয় পায় যে তারা মনে করে যে সংস্কার হোলেই তাদের হাত
থেকে ধর্ম ছুটে গিয়ে নারীদের মুক্তির পথ সুগম হবে। নারীরা ঘর ছেড়ে বাইরের
দুনিয়ায় বের হয়ে আসবে। তাহলে আর নারীদেরকে কন্ট্রোল করা যাবে না।
নারীরা পুরুষদের সাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে চলবে। আর এই পরিবর্তন যদি
আসে তাহলে তাদের এই অরাজকতার রাজ্য এবং তাদের অবিচার সকল কিছু
বন্ধ হয়ে যাবে। তারা কন্ট্রোল হারাবে।
মৌলবাদীরা কোন ধরনের সংস্কারের বিরুদ্ধে। কিন্তু মৌলবাদীদের
মতাদর্শগতভাবে পরাস্ত করেই তো আমাদের প্রগতির পথে অগ্রসর হতে
হবে। সে ক্ষেত্রে আমরা সরকারকে বার বার আত্দসমর্পণ করতে দেখি।
আওয়ামী লীগ করছে আত্মসমর্পণ। আর বিএনপি মৌলবাদের পালে বাতাস
দিচ্ছে।
বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলে ধর্মীয় ফতোয়ার কবলে পড়ে যে কত নারী অপমানিত,
নির্যাতিত, এমনকি মৃত্যুবরণ করছে তার পুরো খবর না জানলেও আজকাল কিছু
কিছু খবরের কাগজে আসছে। অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলে এখনো ধর্ম ব্যবসায়ী ও
মৌলবাদীদের দাপট রয়েছে। তাদের টার্গেট নারী। ২০০১ সালে বিচারপতি
গোলাম রব্বানী সুয়োমোটোভাবে ফতোয়া-সংক্রান্ত একটি মামলায় ফতোয়া
নিষিদ্ধ করেছিলেন। তার এক দশক পরে সুপ্রিমকোর্ট সেই বিচারে ভিন্নমত
প্রদান করেছেন। তাদের মতে, ফতোয়া বৈধ, তবে কেবল শিক্ষিত আলেমরাই তা
পারবেন। এখানে আমার বিবেচনায় আপসের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
নারীনীতি কয়েকবার ঘোষণা করা হয়েছে। কোনোবারই নারী-পুরুষের প্রকৃত
সমতা, বিশেষ করে উত্তরাধিকারের প্রশ্নে সমতা ঘোষণা করা হয়নি। তথাপি
আমরা দেখেছি উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদীদের আস্ফালন, যার কাছে প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা আত্দসমর্পণ করেছেন এবং খালেদা জিয়া বাতাস দিয়েছেন।
পুরুষের একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধকরণ প্রয়োজন। তখনো জামায়াতে ইসলাম
পুরুষের চার স্ত্রী রাখার সপক্ষে বক্তব্য রেখেছিল কোরআন-হাদিসের কথা
বলে। এর আগে উলি্লখিত ভারতের নারী বুদ্ধিজীবী রোশেনারা যথার্থই
বলেছেন, ১৪০০ বছর পূর্বে কোনো এক দেশে সে দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক,
অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে যে আইন পুরুষকে
চারটি বিবাহের অধিকার দিয়েছিল, একবিংশ শতাব্দীর সভ্যসমাজে কোনো
যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছাড়াই পৃথিবীর সমস্ত দেশের মুসলমানদের জন্য তা
এখনো বলবৎ।
সব হাদিস সব সময় অনুসরণ করা সম্ভব নয়। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর
মামুন এক লেখায় এমন বেশ কিছু হাদিস উদ্ধৃত করেছেন, যেমন- দাস প্রথা
চালু করা (মমিনুন ৫, ৬, আহযাব ৫০) ইত্যাদি।
অনেক হাদিসের উৎস নিয়েও প্রশ্ন আছে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক টয়েনবি তার
স্টাডি অব হিস্ট্রি গ্রন্থে বলেছেন, উমাইয়া বা আব্বাসীয় রাজপুরুষরা মদিনা
থেকে শাস্ত্রকারদের বাগদাদে নিয়ে এসে ইচ্ছামতো শাস্ত্র রচনা করিয়ে
নিতেন।… প্রকৃতপক্ষে তারা নিজেদের স্বার্থের দিকে তাকিয়েই ইসলামকে
ব্যবহার করেছিল। আর ওই শাস্ত্রকারদের পোষ মানিয়েছিল শাসকগোষ্ঠী।
ইসলামী আইন দাঁড়িয়ে আছে কোরআন-হাদিস ছাড়াও আরও যে দুটি নীতি ও
ভিত্তির ওপর, তা হলো কিয়াস;ইজমা। ইজমা হলো শাস্ত্রকারদের
সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। কিয়াস-এর অর্থ হলো জ্ঞান-বিবেক,
বিচারবুদ্ধির ওপর নির্ভর করে সমাধান বের করা। ইসলামের মধ্যে প্রগতিশীল
ও গণতান্ত্রিক উপাদান যা আছে, তাকে ব্যবহার করে সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি
রেখে আইনের সংস্কার করা সম্ভব। এখানে উল্লেখ্য, কোরআনে ছয় হাজারের
বেশি আয়াতের মধ্যে ২০০টির মতো আয়াতে আইন ও আইন-সংক্রান্ত
পরামর্শ আছে। তার মধ্যে বিবাহ-সংক্রান্ত ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার-
সংক্রান্ত পারিবারিক আইন ছাড়াও শাসনকার্য পরিচালনা করা সংক্রান্ত
নির্দেশ আছে। সেগুলো কিন্তু মানা হয় না। আমাদের দেশের শাসনকার্য
পরিচালিত হয় সংবিধান দ্বারা। তাহলে সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতিবিধান করে
(যেখানে নারী-পুরুষের সমানাধিকার স্বীকৃত) কেন সব ধর্মের জন্য একক
গণতান্ত্রিক পারিবারিক আইন করা যাবে না?
বাধা হচ্ছে আমাদের শাসকশ্রেণী নিজেই, যারা রাজনৈতিক সুবিধার্থে
মৌলবাদের সঙ্গে বার বার আপস করেছেন। এটা ভাবতে অবাক লাগে, যেখানে
বিগত দুই দশকের বেশি দুজন নারী পালাক্রমে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের
নেত্রী হয়ে এসেছেন, যেখানে নারীরা এভারেস্ট শৃঙ্গে ওঠেন, যেখানে নারীসৈনিক
প্যারাসুটে শূন্য থেকে লাফ দিতে পারেন, যেখানে নারীরা যুদ্ধ পর্যন্ত করেছেন,
সেখানে সে দেশে মৌলবাদের দাপটে নারীর স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়ে
কীভাবে। হেফাজতে ইসলামের মতো সংগঠন কোন সাহসে বলতে পারে, গার্মেন্ট
শিল্পে নারীরা কাজ করতে পারবে না অথবা ক্লাস ফোরের উপরে নারী শিক্ষার
দরকার নেই? তাদের কাছে নারী কেবল ভোগের সামগ্রী মাত্র। অশ্লীল
তেঁতুলতত্ত্ব সেই প্রমাণ বহন করে।
হেফাজত আর জামাত এই দুই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশকে শেষ
করে দিয়েছে। ক্ষমতার লোভ ছাড়তে পারে না এই মৌলবাদীরা। এই সকল নেতা
ক্ষমতার লোভে দেশের যে দশা করেছে তা দেখে সত্যি প্রচণ্ড রাগ হয়। এদের
স্বেচ্ছাচারিতা, ধর্মের অবৈধ প্রয়োগ এবং নারী নির্যাতন, ধর্ষণ সকল কিছু
মধ্যযুগকেও হাঁর মানায়। যেখানে পশ্চিমা দেশের নারীরা পুরুষের সাথে তাল
মিলিয়ে সকল কাজ এক সাথে করে সমতা এনেছে। সেখানে বাংলাদেশে অসহায়
নারীরা এখন মুক্তির পথ খুঁজে চলেছে।