আমি হলফ করে বলতে পারি বাংলাদেশের অধিকাংশ মেয়েরাই রাতের সৌন্দর্য কখনও উপভোগই করেনি। উপভোগ তো দুরে থাক, কখনো ভালো করে রাত জেগেছে, কিংবা রাতে গরম ধোয়া উঠা চা হাতে আড্ডা দিয়েছে এমনও কখনো হয়নি। কিংবা নিঃসঙ্গ রাতে একাকী হেঁটে হেঁটে পথ পাড়ি দেওয়া, কিংবা জোছনা দেখা, কিংবা পাহারে একাকী সময় কাটানো, এসবের কিছুই দেখেনি আমাদের দেশের মেয়েরা। কারন আমাদের দেশে মেয়েদেরকে আসলে পুরুষদের ভোগ্য পণ্য হিসেবেই দেখা হয়। এবং আমাদের সমাজ আমাদের মেয়েদের মাথায় এই চিন্তা চেতনা খুব সূক্ষ্ম ভাবে ঢুকিয়ে দেয়, যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া একদম সহজ বিষয় নয়! মেয়েদের মনের মধ্যে সেট করে দেওয়া হয় যে এই দুনিয়ার সব চেয়ে শ্রেষ্ঠ হলো পুরুষ!
আমাদের সমাজে রাত হলো শুধু মাত্র পুরুষদের জন্য, তাদের উপভোগ এর জন্য। তারা রাত জেগে আড্ডা দিবে, গান করবে, কন্সার্ট দেখতে যাবে, পার্টি করবে কিংবা একা একা ঘুরে বেড়াবে, এতে কারো কোন সমস্যাই নাই। সমস্যা শুধুমাত্র নারীদের জন্য। নারীরা সন্ধ্যা হওয়ার আগেই বাসায় ফেরত আসা চাই!
বেশ কিছুদিন বাংলাদেশের খবরের কাগজ গুলো পড়া হয়নি। তবে আজ পত্রিকা পড়তে গিয়েই হঠাত বনানীর খবরটা পড়ে একদম গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। খবরটি ছিল এরকম যে জন্মদিনের পার্টিতে দাওয়াত করে নিয়ে গিয়ে দুই তরুণীকে ধর্ষণ করেছে এবং তাদের ভিডিও ও করেছে, শুধু তাই না তাদের হুমকিও দিয়েছে!
ধর্ষকরা ধর্ষণ করেছে, তারা তো অপরাধী, কিন্তু পুলিশ কি করলো? তারা তো আমাদের আইন প্রয়োগকারি সংস্থা। কিন্তু তারা তো অপরাধীর চেয়েও অধম! খবরের কাগজে পড়ে অবাক হলাম অভিযোগ দায়ের করতে গিয়ে মেয়ে দুটিকে কত ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। শারীরিক পরীক্ষা করতে সারারাত থানায় থাকতে হয়েছে।
আমি কোনো আইন বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু একজন ধর্ষিত নারী যখন মানসিক এবং শারীরিকভাবেবিধ্বস্ত, তখন তার জন্য সহজ নিয়ম নেই কেন? কেন তাকে বিচার ব্যবস্থা ,আইন প্রয়োগকারীসংস্থাগুলি নিজে থেকে এগিয়ে এসে সাহায্য করবে না? ঘটনার বর্ণনা পরে মনে হচ্ছিলো কিছুদিনআগে দেখা হিন্দি মুভি “পিংক” এর চিত্রনাট্য পড়ছি। ওই ধর্ষিত মেয়েগুলি অমিতাভ এর মতোএকজন সাহসী এবং দক্ষ উকিল পাবে তো?
খুব জানি এই ধর্ষণের ঘটনার পরে কিছু নারী-পুরুষ বিভিন্নভাবে ধর্ষণটাকে জায়েজ করার জন্য নানা রসালো মন্তব্য করবে।
“এতো রাতে কোনো ভদ্র পরিবারের মেয়েরা পার্টি করে? এটা বাঙালি পরিবারের কালচারের সাথেযায় না“- যেন রাতের বেলা ছেলেদের ধর্ষণের খেলায় মত্ত হয় আমাদের কালচারের অংশ!
“আজকালকার মেয়েদের কাপড় দেখেছো? এসব কাপড় পরলে এমন তো হবেই। আমাদের সময় তোএমন হয়নি” – যেন তনু হিজাব পরেও রক্ষা পেয়েছিলো দানবদের হাত থেকে।
“মেয়েরা হলো মধুর মতো। খোলা রাখলে পিঁপড়া তো আসবেই“।– যেন পিঁপড়ারাদের কোনো অপরাধ নেই। মধু নিজেই তার মিষ্টতার জন্য দায়ী।
“ওই মেয়েগুলি তো আসলে নটি, বেশ্যা, ওদের তো প্রতি রাতের কাজ এটা“।- বাংলাদেশে “বেশ্যা“রকোনো পুরুষবাচক শব্দ নেই। তাই খুব সহজেই একটা মেয়েকে অপমান করতে এই উপাধি দিয়ে দেয়াযায়। যেন ধর্ষক হওয়ার চেয়ে বেশ্যা হওয়া অনেক নিচু ব্যাপার —ধিক!
এখন আবার খবরের কাগজে দেখলাম যে একজন ধর্ষকের পিতা তাঁর ছেলের দোষ ঢাকার জন্য তাঁর ছেলের সাবেক স্ত্রীকে দায়ী করছে। তাঁর ভাষ্য যে তাঁর ছেলের প্রাক্তন বউ তাকে ফাঁসানোর জন্য মেয়ে দুইটিকে পাঠিয়েছে।
আর কতকাল ধরে এধরনের নোংরা নাটক চলবে? এই বিত্তশালীরা আর কত বিচারের বাইরে থাকবে? তারা আর কতদিন এধরনের নোংরা অপরাধ করেও পার পেয়ে যাবে? আর কতদিনই বা বাংলার পুলিশ এসব সহ্য করে টাকার কাছে, ক্ষমতার কাছে নিজেদের নতজানু করে রাখবে? আমি বাংলাদেশের নারীদের বলতে চাই, ঘরে বসে নাকি কান্না না করে এসবের প্রতিবাদ করুন, আপন জুয়েলার্স বর্জন করুন।
আমি চাই এই বড় ও ক্ষমতাশালী বাপের ছেলেদের উপযুক্ত শাস্তি হোক, শাস্তির নতুন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন হোক এ বাংলাদেশ। আমি চাই বাংলাদেশের মাটিতে রাতের অধিকারটুকু শুধু পুরুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে নারীদের ও সমান অধিকার থাকুক। এবং নারীদের জন্য উপযুক্ত ও নিরাপদ পরিবেশ ও কামনা করি। তবে ধর্ষকদের উপযুক্ত শাস্তি না হলে এসব কখনওই সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।