নারীদের অগ্রগতি যদিও দেশের উন্নতি ও সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে, তবুও তাদের পারিবারিক অবস্থানে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার এখনো হচ্ছেন নারীরা। আগে এই ধরনের নির্যাতনের কথা নারীরা প্রকাশ করতেন না, এটিকে তারা ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে দেখতেন অথবা লজ্জার বিষয় মনে করতেন। কিন্তু বর্তমানে তারা নিজেদের কণ্ঠ উচ্চারণ করছেন। এদিকে, নারী নির্যাতন রোধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে অনেকদিন ধরে কাজ করা হচ্ছে। তবে নির্যাতনের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। এর মূল কারণ হলো নারী নির্যাতন এখনো জাতীয় সমস্যা হিসেবে গণ্য হচ্ছে না। চারপাশে নির্যাতন দেখেও অনেকে তা মেনে নিচ্ছেন।
বিভিন্ন তথ্য অনুসারে, চার ধরনের নির্যাতনের উল্লেখ আছে: শারীরিক, যৌন, মানসিক ও অর্থনৈতিক। বাইরের পরিবেশের মতো, পারিবারিক পরিসরেও নারীরা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকেন এবং নির্যাতনের শিকার হন।
দেশের বিবাহিত নারীদের মধ্যে ৮৭% নারী তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে, কোনো না কোনো রূপে স্বামীর কাছ থেকে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
এদের মধ্যে ৬৫% নারী জানান, তারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, ৩৬% যৌন নির্যাতন, ৮২% মানসিক নির্যাতন এবং ৫৩% অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
নারীরা, যাঁরা শারীরিক নির্যাতনের কবলে পড়েছেন, তাঁদের মধ্যে কেবল অর্ধেকেরই চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। অনেক নারী স্বামীর আশংকা বা অনমতির কারণে ডাক্তারের কাছে যেতে পর্যন্ত পারেন না, যার পরিমাণ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।
অর্থনৈতিক অত্যাচারের শিকার হয়েছেন বহু বিবাহিত নারী, যার প্রমাণ হিসেবে প্রায় অর্ধেক নারী তাদের স্বামী দ্বারা হাতখরচ পেতে অনিচ্ছার কথা বলেছেন। সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও প্রায় ১৭ শতাংশ স্বামী সাংসারিক খরচে অর্থ দিতে অস্বীকার করেন।
যৌন নির্যাতনে অবিবাহিত নারীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকলেও, মানসিক নির্যাতনে প্রধানত বিবাহিত নারীরা বেশি শিকার হন, বিশেষ করে স্বামীর বাড়িতে। এই জরিপে প্রকাশ পেয়েছে যে, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনে প্রায় ৭ শতাংশ নারী আত্মহত্যা প্রচেষ্টাও করেছেন। ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হওয়ার হার অ্যাখ্যানে ৫৬ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে তুলনামূলকভাবে নির্যাতনের ঘটনা বেশি এবং বয়সের সাথে নির্যাতনের ধরন পরিবর্তিত হয়ে থাকে।
স্বামী ব্যতীত পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নারীকে নির্যাতনের শিকার করে, যেখানে ২৯ বছরের কম বয়সী নারীরা আরো বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। উন্নত বিশ্বের নারীরা পারিবারিক নির্যাতন থেকে মুক্তি পায় না, যেমন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২০১০ সালের জরিপ অনুযায়ী, প্রতি চার নারীর মধ্যে একজন জীবনে কোন সময়ে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন।
পারিবারিক নির্যাতনের ফলে এই নারীরা মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন, যা হীনম্মন্যতা, হতাশা, প্রচ্ছন্ন থাকার প্রবণতা, রাগ এবং ক্ষোভের মত অনুভূতি তৈরি করে। এই মানসিক দুর্বলতা অনেক সময়ে মানসিক চরম বিপর্যয়ে নারীদের নিয়ে যায়, যেতে পারে আত্মহত্যার দিকে, বা সন্তান বা স্বজনের প্রতি হিংসাত্মক আচরণের দিকে। কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, অথবা নেশায় আসক্ত হয়ে উঠে।
এই ধরণের অত্যাচার রোধের জন্য নারীদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও শিক্ষা বৃদ্ধি অপরিহার্য। এর ফলে নারীরা নিজেদের আত্মমর্যাদা অনুভব করবে এবং নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে। তবে, সব কিছুর আগে সমাজের মানসিকতায় পরিবর্তন আবশ্যক। এক সময়ে নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশিত হতো না, কিন্তু এখন তা প্রকাশ পাচ্ছে। নির্যাতনের ধরন এবং তার প্রকৃতি পরিবর্তিত হচ্ছে। সরকার নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে এবং জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এর প্রতিকারে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
মূল সমস্যা হচ্ছে নারীদের কর্তৃত্বের অভাব। যে ব্যক্তি নির্যাতন করে, আইন প্রণয়ন করে এবং বিচার প্রদান করে, সবাই পুরুষ। এর ফলে নির্যাতনের যথার্থ বিচার হয় না। দুর্বল আইনের শাসন এ ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করছে। যতক্ষণ পর্যন্ত এই সাংস্কৃতিক মানসিকতা পরিবর্তন না হবে, ততক্ষণ নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব হবে না। নারীদের ক্ষমতায়ন এবং সমাজের সব ক্ষেত্রে তাদের সমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা অত্যন্ত প্রয়োজন।