যত নারীদের সুন্দরী প্রতিযোগিতা হয় সেখানে নারীদেরকে পণ্য করা ছাড়া আসলেই কি সেখানে সুন্দরকে খোঁজা হয়? নারীদেরকে বিশ্ববাজারে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য এই সকল সুন্দরী প্রতিযোগিতার কোন প্রয়োজন আদৌ আছে কি? কেন একজন নারীকে কাপড় খুলে পুরো শরীর দেখানোর প্রয়োজন হয় এক সুন্দরী প্রতিযোগিতায়? কেন নারীদেরকে পুরুষের চোখে ভালো লাগাড় জন্য সাজতে হবে? নারীরা কেন পুরুষকেই সুখী করতে পারলে জীবন সার্থক এই ধারনায় বিশ্বাসি?

ফেসবুক-মিডিয়াজুড়ে হৈচৈ হচ্ছে ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ নিয়ে। কাছের দুয়েক-একজন ইনবক্স করেছেন, এ নিয়ে আমি কোনো পোস্ট দিচ্ছি না দেখে। বলেছি, ‘অসুন্দর (ফিতার হিসেবে) মানুষ আমি। অতো সুন্দর নিয়ে মাথা ঘামিয়ে নষ্ট করতে চাই না।’ আসল কথা তা না। আমি মনে করি, এই প্রতিযোগিতার সাথে নারীশক্তির উত্থানের কোনো সম্পর্ক নেই। থাকলেও সেটা রিভার্স। মিস কিংবা মিস্টার ওয়ার্ল্ড, যাই হোক না কেন–এটা মানুষকে পণ্য করে দেখা ছাড়া আর কিছু না। সৌন্দর্য মেপে দেখার জিনিস না। এটা দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। দশজন একমত হয়ে একজনকে বিশ্বসেরা সুন্দরী/সুন্দর হিসেবে ঘোষণা করল, আমি সেটা মানবো কেন? প্রকৃত সৌন্দর্য ব্যক্তির ভেতর থেকে আসে। সেটা ফিতা দিয়ে মাপবার জিনিস না। Confucius বলছেন, Everything has beauty, but not everyone sees it. আমি এটা বিশ্বাস করি।

‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ জান্নাতুল নাঈম কাঁদলেন লাইভে এসে। তিনি বলেন যে, চারপাশের প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে সংগ্রাম করে আজ এ অবস্থানে তিনি এসেছেন। তিলে তিলে নিজেকে তৈরি করেছেন। খুবই ভালো কথা। স্যালুট তাকে। কিন্তু আমি মনে করি, নারীশক্তির প্রকাশ এইসব বিউটি কনটেস্টে নিজেকে চ্যাম্পিয়ন করার ভেতর দিয়ে ঘটবে না। এটা পুঁজিবাদ ও পুরুষতন্ত্রের ফাঁদ। এই ফাঁদে পা দিয়ে আপনি স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবেন না। নারীর জন্য যে বিউটি মিথ, সেটা এখন বোঝার সময় হয়েছে।

বিষয়টা নিয়ে লিখেছেন এই সময়ের একজন প্রখ্যাত মার্কিন নারীবাদী লেখক নাওমি উলফ (জন্ম ১৯৬২)। ‘দ্য বিউটি মিথ’ (১৯৯১) গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নজর কাড়েন। এই বইটিতে তিনি দেখিয়েছেন যে ‘সৌন্দর্য’ নীতিবোধের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত নয়। বরং সম্পূর্ণই সামাজিক বলয়ের রসায়নে সৃষ্ট একটা ধারণামাত্র। পুরুষতন্ত্র নিজের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য এই নির্মাণ-বিনির্মাণের উপাত্তকে নির্ধারণ করে দেয় এবং পুরুষ তার স্বার্থেই সেগুলো ব্যবহার করে। নারী সৌন্দর্যের এই পুরুষতান্ত্রিক মিথের ফাঁদে পা দিয়ে পুরুষতন্ত্রকে বৈধতা দিচ্ছে, যা সার্বিক নারীমুক্তির অন্তরায়।

দ্য বিউটি মিথ শীর্ষক প্রবন্ধের কিছু অংশে তুলে দিচ্ছি। আমি পাক্ষিক অনন্যার জন্য বইটির নাম-প্রবন্ধটা অনুবাদ করিয়েছিলাম সাঈদা সানীকে দিয়ে। তাঁর অনুবাদ থেকে উদ্ধৃত করছি।

[…] ‘যতদিন পুরুষতন্ত্র থাকবে, ততদিন নিশ্চিতভাবেই সৌন্দর্যপুরাণ কোনো না কোনো আদলে টিকে থাকবে।..নারীর ওপর বস্তুগত নিয়ন্ত্রণ ভয়াবহভাবে শিথিল হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে এই মিথ বা পুরাণ বিকশিত হয়ে উঠেছে। ইউরোপে শিল্প-বিপ্লবের আগে ‘সৌন্দর্য’ সম্পর্কে গড়পড়তা নারীর অনুভূতি আধুনিক নারীর মতো ছিল না। গণমাধ্যমে প্রচারিত দৈহিক আদর্শের অবিরাম তুলনার ভিতের ওপর নির্মিত হলো সৌন্দর্যপুরাণের সৌধ। আধুনিক নারীরা সেই সৌধে আসীন হয়ে অর্জন করে এই মিথটার অভিজ্ঞতা। বহুমাত্রায় ও বিপুল পরিমাণে কপি সৃষ্টির প্রযুক্তিগত বিকাশের পূর্বেÑদাগেরা চিত্র, ফটোগ্রাফ ইত্যাদির প্রচলন ছিল, সাধারণ নারীর অধরা ছিল না। যেহেতু পরিবার ছিল একটি উৎপাদকযন্ত্র এবং নারীর কাজও ছিল পুরুষের পরিপূরক। তাই যারা অভিজাত বা গণিকা ছিল না, সেই সব নারীর মূল্য তাদের কর্মদক্ষতা, অর্থনৈতিক সামর্থ্য, শারীরিক শক্তি এবং সৃজন দ্বারা নির্ধারিত হতো। অবশ্যই সেখানে শারীরিক আকর্ষণের ভূমিকা ছিল বিপুল; কিন্তু ‘সৌন্দর্য’ বলতে আমরা যা বুঝি, তা বিয়ের বাজারে সাধারণ নারীদের ক্ষেত্রে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না। শিল্পায়নের উত্থানের পর সৌন্দর্যপুরাণের আধুনিক ধরন সুনির্দিষ্ট রূপ লাভ করে।

১৮৪০-এর দশকে প্রথমবারের মতো গণিকাদের নগ্ন ছবি তোলা হয়। এই শতকেরই মধ্যভাগে প্রথম সুন্দরী নারীদের ছবি ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। সমাজের সুন্দরীদের এবং অভিজাত গৃহিণীদের ধ্রুপদী শিল্পকর্ম, পোস্টকার্ড, কুরিয়ার, ইভস প্রিন্ট এবং চীনামাটির আবক্ষ মূর্তির নতুন জোয়ার সৃষ্টি হয়, যেই বদ্ধভূমিতে ক্রমশ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে মধ্যবিত্ত নারীরা।

শিল্প-বিপ্লবের সময় থেকেই, মধ্যবিত্ত পশ্চিমা নারীরা বস্তুগত চাপের মতোই আদর্শ এবং ছাঁচেঢালা নমুনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। এই শ্রেণির কাছে পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে এই অর্থ দাঁড়ায় যে, এই ‘সাংস্কৃতিক ষড়যন্ত্র’ তাদের কাছে যেন আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিসংগতই বলে মনে হয়। নারী ভুবনের প্রাকৃতিক উপাদানগুলোকে কৃত্রিমতার মোড়কে আবদ্ধ করা সামাজিক কল্পলোকের অনেকগুলো উদ্ভবের একটি, যার হাত ধরে উত্থান হয় সৌন্দর্যপুরাণের। নারীর মনন এই কৃত্রিম সৌন্দর্যবোধে বন্দি রাখার ব্যবস্থাও সৌন্দর্যপুরাণের একটি অংশ।

‘সৌন্দর্য’-এর ধারণাকে ব্যবহার করে, এর নিজস্ব আইন, অর্থনীতি, ধর্ম, যৌনতা, শিক্ষা এবং সংস্কৃতি দিয়ে পুনর্নির্মাণ করে, একটি বিকল্প মেয়েলি জগত তৈরি হয়। এই উপাদানগুলো প্রত্যেকটি আগের চাইতে বেশি দমনমূলক হয়ে ওঠে।

… বিপুল প্রভাবশালী বিশ্ববাজারের শিল্পকারখানায় বছরে তিন হাজার তিন শ কোটি ডলারের ডায়েট শিল্প, দুই হাজার কোটি ডলারের প্রসাধনী শিল্প, ৩০ কোটি ডলারের কসমেটিক সার্জারি শিল্প এবং সাত শ কোটি ডলারের পর্নোগ্রাফী শিল্প এখন বাস্তবতা। অসচেতন উদ্যোক্তাদের থেকে তৈরি হওয়া এই শিল্প ও বিনিয়োগ নতুন পুঁজি সৃষ্টি করছে এবং মানব সংস্কৃতিতে এর ব্যাপক প্রভাব তৈরি করেছে। ফলে এই উদীয়মান অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য সৌন্দর্যপুরাণের ভ্রান্তিকেই ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে। অর্থনৈতিক বিপুল প্রভাব এই মিথকে আরও প্রণোদিত এবং শক্তিশালী করেছে।

আমরা নারীরা কত বোকা না? আমাদের নিজের স্বত্বাকেই আমরা ভালবাসতে পারি না। নিজের জন্য আমরা আজকাল কতটুকু বাঁচি? নিজেকে আমরা আজকাল কতটুকু সময় দেই? অলীক সুখের পিছনে গা ভাসিয়ে দিয়ে সাঁরা জীবন সুখের খোঁজে খোঁজে যখন মৃত্যু এসে দোরগোড়ায় বসে থাকে তখন মনে হয় আহারে সারাজীবন অনন্যার জন্যই বাছলাম নিজের জন্য বাছলাম না। নিজের জন্য অথবা নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিলাম না। নিজেকে নিয়ে যদি ভাবতাম তাহলে জীবনের এই শেষ সময়ে আফসোস করতে হত না ?