লিখেছেন অরণ্য রাত্রি

আমি  যখন এই কমিউনিটি তে প্রথম আসি তখন অনেকের কাছে শুনতাম তারা ছোট বেলায় সেক্সুয়াল এবিউজের শিকার। ভাগ্য গুনে আমি কখনো এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হই নি। সেক্সুয়াল এবিউজ খুব মারাত্মক একটি অপরাধ আর যদি সেটা হয় শিশু বয়সে তাহলে এর মতো জঘন্য আর কিছু হতে পারে না । এই অপরাধটি আমাদের দেশে দিন দিন বাড়েই চলেছে। শিশুকালে সেক্সুয়াল এবিউজ খুব কাছের মানুষ দ্বারা, আপন জন দ্বারা, ঘরের মানুষের দ্বারাই বেশি হয়ে থাকে।এমন কি যাদের সেই শিশুটি কে রক্ষা করার কথা দেখা যায় তারাই এই ঘৃণ্য কাজটি করছে।

কেউ কেউ টিউটর বা হুজুর যে কুরআন শিখাতে এসেছে তার দ্বারা এবিউজড হয়।এমন কি মামা , চাচা  দের দ্বারা হতে পারে। যে মামা , চাচা কোলে নিয়ে আদর করে , খেলনা কিনে দেয়, চকলেট কিনে দেয় দেখা যায় সেই হয়তো সুযোগ পেয়ে বাচ্চা টা কে সেক্সুয়ালি এবিউজ করে।তবে সব মামা চাচা রা  কিন্তু এমন  নয়। গুটি কতক মানুষ এমন। বয়সে বড় কাজিনরাও কিন্তু বাদ পড়ে না  এই লিস্ট থেকে।এমন শুনেছি কোন আত্মীয়ের বিয়ে হচ্ছে। ঢালাও বিছানা করে দেয়া হয়েছে। কোন একটি বাচ্চার পাশে শুয়েছে তার মামা। গভীর রাতে বাচ্চাটি খেয়াল করলো তার মামা তার যৌনাঙ্গে হাত দিচ্ছে। আবার কোন কাজিন কোন এক বাচ্চার সাথে একই ঘর শেয়ার করছে। একি বিছানা শেয়ার করছে। আর দিনের পর দিন সেক্সুয়াল এবিউজ করে যাচ্ছে। মাদ্রাসার কথা তো সবার জানারই কথা। সেটা আর নাই বললাম।

শিশু রা কিন্তু বেশিরভাগ সময় সেক্সুয়াল এবিউজের কথা বলে না। কারণ তারা ভয় পায়। আমি একদম শৈশবের কথাটি এখানে বলতে চাচ্ছি। হয়তো শিশু টি কে বলা হয়

“ এটা একটা খেলা। এই খেলাটা শুধু তোমার এবং আমার মধ্যে এবং এটা কাউকে বলা যাবে না।তুমি যদি কাউকে কিছু বল আমি কিন্তু সবাই কে বলবে তুমি একটা খারাপ। আমি বড়। তাই সবাই আমার কথা শুনবে, বিশ্বাস করবে”।

শিশুটি তখন মনে করে তার বাবা মা তাকে বিশ্বাস করবে না, উলটা বকা দিবে। শিশুটি তখন আর কাউকে কিছু বলে না।প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় তার মাঝে। তার মাঝে কিছু পরিবর্তন আসে। যেমন

•           কেউ কেউ নিজেকে একদম গুটিয়ে নেয়

•           কেউ খুব এগ্রেসিভ হয়ে যায়।ঘরের জিনিস-পত্র ভাংচুর করে। অল্পতে রাগ দেখায়।

•           দুঃস্বপ্ন দেখে প্রায়ই

•           ভয় পায় একা একা থাকতে

•           সেক্সুয়াল বিষয় নিয়ে ছবি আঁকা যা এই বয়সে করার কথা নয়।

•           কিছু শারীরিক লক্ষণ থাকতে পারে। যেমন যৌনাঙ্গ এবং মুখের আশে পাশে আঘাতের চিহ্ন। ব্যথা  অনুভব করা

এখানে হয়তো এখনো কেউ বাবা মা নন। হয়তো কেউ ভবিষ্যতে বাবা মা হবেন । কিংবা সন্তান দত্তক নিবেন। আর কেউ কেউ হয়তো বড় ভাই বা বড় বোন যারা কোন একটি শিশুর অভিভাবক। বলা যায় আমাদের প্রত্যেকেরই উচিৎ জানা, চিন্তা করা কিভাবে  একজন শিশু কে সেক্সুয়াল এবিউজের হাত থেকে রক্ষা করা যেতে পারে???

আমাদের দেশে স্কুলে সেক্স এডুকেশন নেই।তাই অভিভাবক দেরই দায়িত্ব এই ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া। কারণ উপযুক্ত শিক্ষা ছাড়া একটি শিশু কে রক্ষা করা খুব মুশকিল।একটি শিশু কে শরীরের বিভিন্ন অংশের নাম শেখানোর মাধ্যমে আমরা শুরু করতে পারি। ১৮ মাস থেকে ৪ বছর পর্যন্ত শিশু তার শরীরের অংশের সম্পর্কে ধারণা নেয়।পাঁচ বছর বয়সে এসে শিশু কে শেখাতে হবে তার  গোপনাঙ্গ কোন গুলো। শরীরের এই অংশ গুলো কে নো টাচ জোন বলতে পারি।

একটি শিশু কে এই ব্যাপার গুলো শেখানোর সময় পুতুল ব্যবহার করা যেতে পারে। খেলার ছলে পুতুল দিয়ে বুঝালে শিশুটি উৎসাহের সাথে এবং সহজে ব্যাপার টা গ্রহণ করতে পারবে।একটা সেফটি সার্কেল তৈরি করতে হবে। যে সাইকেলে থাকবে বাবা , মা দাদা ,দাদি , নানা ,নানী  , কখনো বড় ভাই বোন বা অন্য অভিভাবক। এই সার্কেলের সদস্যরা সবাই শিশু টির জন্য নিরাপদ।

শিশু কে বলতে হবে

“প্রাইভেট পার্ট একান্তই তোমার। বাবা , মা কিংবা সেফটি সার্কেলের কেউ ছাড়া এক মাত্র তুমি এটা কে স্পর্শ করতে পারো। আর কেউ নয়।”

আরেকটি কথা অনেক সময় শিশুদের কে বলা হয় না। তাদের কে বলতে হবে

“তুমি যেমন তোমার প্রাইভেট পার্ট কাউকে স্পর্শ করতে দিবে না তেমনি তুমিও কারো প্রাইভেট পার্ট স্পর্শ করবে না।”

এই ক্ষেত্রে একটি ঘটনার কথা বলা হয় যা বাইরের একটি দেশে ঘটেছে। একটি শিশু স্কুলে মাঠে আহত হয়। তাকে স্কুলের নার্সের ঘরে আনা হয়। শিশুটি প্রাইভেট অংশে ব্যথা অনুভব করছে।কিন্তু শিশুটি তাকে দেখতেই দিবে না। কারণ সে জানে নার্স সেফটি সার্কেলের অংশ নয়। তখন নার্স শিশুটির বাবা কে ফোন করে অনুমতি নেয়।

এবার শিশু কে শেখাতে হবে স্পর্শ কত প্রকার?

স্পর্শ ২ প্রকার হতে পারে।

১। মন্দ স্পর্শ

২। ভাল স্পর্শ

কোন স্পর্শটি ভাল? শিশু কে বলতে হবে

•           “যে স্পর্শ তোমাকে ভাল অনুভব করাবে। যে স্পর্শে তুমি নিজে কে নিরাপদ ভাববে। যে স্পর্শ তোমাকে আনন্দ দিবে। যেমন মা যখন জড়িয়ে ধরে , বাবা যখন কপালে চুমো খায়”।

কোন স্পর্শটি মন্দ? শিশু কে বলতে হবে

•           “যে স্পর্শে তোমার ভাল লাগে না। যে স্পর্শে তোমার অস্বস্তি হয় । ছুটে চলে আসতে ইচ্ছা করে। যেমন যখন কেউ তোমার প্রাইভেট পার্ট স্পর্শ করে অথবা অন্য কারো প্রাইভেট পার্ট স্পর্শ করার জন্য জোর করে”।

সেফ ওয়ার্ড

 শিশু কে তিনটা সেফ ওয়ার্ড শেখাতে হবে

•           স্টপ

•           রান

•           টেল

স্টপ

একটি শিশু কে বলতে হবে

“যখন কেউ তোমার প্রাইভেট পার্ট টাচ করতে যাচ্ছে, তোমার অস্বস্তি লাগছে তুমি সবার আগে এটা বন্ধ করার চেষ্টা করবে। জোরে চিৎকার করে না বলবে”।

রান

“যে জায়গায় আছ ছুটে চলে আসার চেষ্টা করবে”।

টেল

“যারা সেফটি সার্কেলে রয়েছে বা যাদের কে নিরাপদ মনে করবে তাকে যেয়ে পুরো ঘটনা খুলে বলবে “।

এবার আসুন আমাদের করনীয় কি?

শিশুটির কাছে নিজেকে  বিশ্বস্ত করে তোলা । শিশুটিকে নিশ্চিত করা যে আমরা তার পাশে রয়েছি। এমন কিছু না করা যাতে শিশুটি আপনাকে কিছু বলার আগে দশবার ভাবে। শিশু কে বলা যেতে পারে।

“আমি তোমাকে কক্ষনো খারাপ ভাবি না। তোমাকে আমি সবার আগে বিশ্বাস করি।আমি জানি তুমি খুব ভাল একটা বেবি। কেউ যদি তোমার প্রাইভেট পার্ট স্পর্শ করে সে মানুষটা খারাপ। তুমি কক্ষনো খারাপ না”।

অপরিচিত মানুষের দ্বারাও শিশু রা সেক্সুয়াল এবিউজের শিকার হতে পারে। সেই জন্য তাদের কে আগে থেকেই অপরিচিত মানুষের সাথে যাতে কোথাও না যায় সেই ব্যাপারে সতর্ক করতে হবে।

কিন্তু দুঃখ জনক হল এত কিছুর পর যখন একজন এবিউজার যখন ধরা পড়ে তখন বেশির ভাগ বাবা মা চান না ব্যাপার টা সবাই জানুক।তারা প্রকাশ করতে চায় না যে তার সন্তান সেক্সুয়াল এবিউজের শিকার বা শিকার হতে যাচ্ছিল। ফলে তারা আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে নিজেদের মাঝেই ব্যাপার টা মিটিয়ে নেয়। এর ফলে সেই ব্যক্তি পরবর্তী তে আবার অন্য কারো শিশুকে আবার এবিউজ করার সাহস পায়।

আসুন একটি শিশুর শৈশব কে আনন্দময় করে তুলি। সেক্সুয়াল এবিউজের হাত থেকে শিশুদের কে রক্ষা করি। এবং যে সকল মানুষরূপী জানোয়ার যারা শিশুদের কে সেক্সুয়ায়ালি এবিউজ করে তাদের কে আইনের হাতে সোপর্দ করি।