সিএনজিতে আমরা তিনজন, কারোর মুখে কোনো কথা নেই। ফার্মগেট পার হয়ে নাখালপাড়ায় উঠতেই থ্রি-হুইলারের ছোট্ট কামরায় ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল। ইফতারের আগে আগে খালি রাস্তা পেয়ে সিএনজি দুই পাশের দুই পাখাতে ভর করে মাটি ছেড়ে আকাশে উড়াল দিল। সাই সাই করে পায়ের নিচে দিয়ে একদল টোকাই, কয়েকটা রি-চার্জের দোকান, রেন্ট ই কার, বাসের ডিপো, সারি সারি ডাস্টবিন আর কত কি যে হারিয়ে গেল!  চামড়ার নিচের পাঁজরটায় একবার হাত বোলালাম। কারোর মুখে কোনো শব্দ নেই, বোবা উত্তেজনা চামড়া কামড়ে ধরেছে। বহু নাটক আর অনিশ্চয়তার পর আজ রূপবানের দ্বিতীয় সংখ্যার ডেলিভারি আনতে যাচ্ছি, আমরা তিনজন। গত চার মাস ধরে রূপবানের দ্বিতীয় সংখ্যার সফট কপি পেন ড্রাইভে ভরে বুকপকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমাদের আগের ছাপাখানা রূপবান ছাপাতে পারবে না বলে দিয়েছে। চার মাস ধরে একের পর এক ছাপাখানায় ধরনা দিচ্ছি, কেউ রূপবান নিতে রাজি হচ্ছে না। একদিন জুলহাজ ফোন করে বলল মন্ত্রীসভায় প্রধানমন্ত্রীকে রূপবান দেখানো হয়েছে, সাবধান। এরপর আবার ভোরের কাগজে রিপোর্ট এলো গোয়েন্দারা নাকি আমাদের খোঁজে। ভয়ে কুঁকড়ে যাই, তারপরেও বুকপকেটের পেন ড্রাইভটা হারাই না। জুলহাজ একদিন না পেরে বলে বসলো, চল পিডিএফ করে অনলাইনে দিয়ে দেই।

জুলহাজ আমার পাশে বসে আছে। গায়ে হালকা বাদামী কুর্তা কাটের শার্ট আর ফর্মাল প্যান্ট। অফিস থেকে সোজা সিএনজি নিয়ে নাখালপাড়া। ওর মুখের দিকে একবার কি তাকিয়েছিলাম? মনে হয় না। আমাদের যোগাযোগের ধরনটা আমি কোনোদিন কাউকে ঠিকঠাক বলে বোঝাতে পারবো না।। আমরা দুজন দুজনের যত কাছাকাছি আসি, তত আমাদের কথা বলার বিষয় ফুরোতে থাকে। একজন আরেকজনের দিকে তাকাই না, বিশেষ আন্তরিকতা দেখাই না। অথচ দুজন দুজনের উপস্থিতির প্রতি কৃতজ্ঞ, দুজন পাশাপাশি প্রচণ্ড নির্ভার। আমি তাই ওর চোখের দিকে বিশেষ তাকাই না, তাকালে হয়ত ওর চামড়ার কামড়টা টের পেতাম ।

‘অমুক’ টিভির অফিসের সামনে সিএনজি থেকে নামলাম। তারপর? মনে নেই। জুলহাজ এর পকেটে কি ওইদিন ভাংতি ছিল না? আমার একটামাত্র টিউশনিটাও তখন আর নেই। পকেট ফাঁকা। আমি অপেক্ষা করছি জুলহাজ সিএনজির পুরো ভাড়াটা দিয়ে দিবে। ও কি আমার কাছে ভাংতি চাচ্ছে? কিন্তু আমার কাছে তো টাকা নেই। কি লজ্জা! ওর মুখের দিকে তাকাইনি। তাকালে হয়তো ওর কামড়টা টের পেতাম।

এর মধ্যে মাগরিবের আযান শুরু হয়ে গেলো।

আমরা দুজন বহু মাগরিবের আজান পাশাপাশি থেকে শুনেছি। ঐদিন রূপবানের দ্বিতীয় সংখ্যার ডেলিভারির দিন না হলে হয়তো কোনো কারণ ছাড়াই ওর বাসায় চলে যেতাম। কেউ কারো দিকে না তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা পার করে দিতাম।ও হয়তো গুন গুন করে গান ধরতো, কাপড় বদলাতো, অফিস থেকে ফিরে এসে ঝাঁটা হাতে সারা বাড়ি চষে বেড়াতো। আতঙ্কিত আমি ঘরের যে কোনায় গিয়ে লুকোতে চাইতাম , সেখানেই ঝাঁড়ু হাতে পৌঁছে যেতো জুলহাজ, ওর মুখের দিকে না তাকিয়েই শুনতে পেতাম সেই অমোঘ নির্দেশ,

-পা-ওঠাও, ওখানে ময়লা।

ও আমার দিকে তাকায়নি কিংবা আমিও ওর দিকে না, তবুও দুজন দুজনের উপর সমান ভাবে বিরক্ত। পা ওঠাতে ওঠাতে ওর গুন গুন গানের কলিগুলো মাগরিবের আযানের সাথে মিলে মিশে একাকার, যেন মৌসুমির প্রেতাত্মা গাইছে- ‘কিছু ফেলতে পারি না!’

সিএনজি চলে যাচ্ছে । জুলহাজ ভাংতি কোথায় পেল? আসলেই কি ওর ভাংতি ছিল না ঐদিন নাকি এতদিনের স্মৃতি হাতড়ে তলা থেকে কেবল মরীচিকা তুলে আনছি? ওসব চুলোয় যাক, আমরা সামনে এগোই। কারণ আমি জানি একটু পরে আমরা আমাদের ছাপাখানায় যাবার রাস্তাটা হারিয়ে ফেলবো। এখানে এর আগেও অনেকবার এসেছি আমরা। রূপবানের গুপ্ত প্রেস। এখানে লোকচক্ষুর অন্তরালে ভীষণ গোপনে রূপবানের দ্বিতীয় সংখ্যার মুদ্রণ চলছে। সেই নিয়ে গত সাত মাসে কত নাটক। রূপবানের শুরুতে আমাদের ইচ্ছা ছিল বছরে তিনটা সংখ্যা। অন্যান্য ম্যাগাজিনের মত রূপবানের প্রথম সংখ্যার পর দ্বিতীয় প্রকাশ কিছুটা মসৃণ হবার কথা ছিল। কিন্তু কপালে শনি, চারপাশ থেকে অক্টোপাসের অশুভ শুঁড় আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল। প্রধানমন্ত্রী নাকি মন্ত্রীসভার স্ট্যান্ডিং কমিটিতে রূপবান দেখে নাখোশ হয়েছেন। এদিকে ভোরের কাগজে বড় করে রিপোর্ট বের হয়েছে গোয়েন্দা বাহিনী রূপবানের পেছনের লোক খুঁজছে। রূপবানের দ্বিতীয় সংখ্যা এপ্রিলে বের হবার কথা থাকলেও যেহেতু আমরা পৃষ্ঠা বাড়িয়েছি, তাই মে মাস লেগে গেলো লে-আউট শেষ করতে করতে। যেই না কাজ গুটিয়ে প্রিন্টিং-এ যাবো যাবো, তখনই এই অঘটন। রূপবানের প্রথম সংখ্যা বের হয়েছিল যে ছাপাখানা থেকে, ভোরের কাগজের রিপোর্ট বেরোবার পরের দিনই জানিয়ে দিলো তারা আর আমাদের ম্যাগাজিন ছাপাতে পারবে না।আমি তখন নিতান্তই ভেঙে পড়েছিলাম। রূপবান ছাপানোর শোকে না, ডিবি পুলিশের ভয়ে! বাসায় কলিং-বেল বাজলেই মনে হয় পুলিশ। রাস্তায় কেউ পেছনে হাঁটলে মনে হয় গাড়িতে করে তুলে নিয়ে গুম করে ফেলবে। মনে মনে প্রত্যেকদিন ডিবি পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে কি বলব তার রিহার্সাল করি আর ভাবি সব জানাজানি হলে আমার মা-টার কি হবে। ইচ্ছা করে ইউনিভার্সিটির ক্লাস ফাঁকি দেই কারণ ওখানে সবাই যেনে গেছে আমি ‘গে’ ম্যাগাজিন করি। এর মধ্যে একদিন দেখি তসলিমা আমার ম্যাগাজিন নিয়ে টুইট করছে। ব্যস! রূপবান এখন নাস্তিক ম্যাগাজিন!

এখনো মাগরিবের আযান শেষ হয়নি। আমরা আমাদের প্রেস এখনো খুঁজে পাইনি। এটা ঢাকা-এর বেশ পরিচিত মুদ্রণ পাড়া। আশেপাশে সারি সারি একই ঢঙের প্রিন্টিং প্রেস। এর আগে যে-কবার এসেছি, তখন আশে পাশের সব দোকান খোলা ছিল। ঈদ এর তিনদিন আগে এখন সব বন্ধ। আমাদের প্রেসটা চেনার আর কোনো উপায় নেই। আমি মোবাইলের দিকে হাত বাড়াই। ডায়াল লিস্ট থেকে মাসুম ভাইকে খুঁজে বের করি।

মে মাস কেটে গেলো আতঙ্কে । বাসার কম্পিউটার থেকে রূপবানের যাবতীয় জিনিস আরেকটা হার্ড ড্রাইভে ভরে অন্য এক বন্ধুর বাসায় রেখে আসলাম। জুলহাজ এরমধ্যে একদিন মেসেজ দিল,

-তোমার কম্পিউটারে গে পর্ন আছে? ডিলিট ইট ইমেডিয়েটলি। পুলিশ আসলে কোনো ঝামেলা করবা না। কোনোকিছু অস্বীকার করবা না। চুপচাপ থানায় যাবা। ওখানে গিয়ে সবার আগে আমার নাম বলবা। বলবা জুলহাজ মান্নান সব নাটের গুরু।

-মাসুম ভাই, আমরা আপনার অফিস খুঁজে পাইতেছি না, একটু ‘অমুক’ টিভির ওখান থেকে আমাদের নিয়ে যান না।

-আরে ভাই, আমি তো ইফতার করি। দাঁড়ান কাউরে পাই কিনা। পাঠাইতেছি।

আজানটা শেষ হয় না কেন! জুলহাজের ঘর গোছানো শেষ। আমরা একটা শব্দ বিনিময় না করে, কেউ কারোর দিকে একবারও না তাকিয়ে একজন আরেকজনের সঙ্গ উপভোগ করে যাচ্ছি । জুলহাজ আলমারি খুলে কয়েকটা মোম বের করে ওর বারান্দায় রাখা বড় কালো পদ্ম রাখা গামলায় ভাসিয়ে দিলো। মোমের কাঁচা-পাকা আলোয় পদ্মপাতার নিচে কিলবিল করতে থাকা মাছগুলো কিছুক্ষণ পরপর দিকভ্রান্ত হয়ে গামলায় ঢুস-ঢাস বাড়ি খাচ্ছে । আমি ওর দিকে না তাকিয়েও সব দেখতে পাই। কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো ঘর ভরে গেলো ল্যাভেন্ডারের মাতাল ঘ্রাণে। রং, আলো আর ঘ্রাণের প্রতি ওর যে বাড়াবাড়ি বাতিক ছিল, সেটা কি এখনো আছে? জুলহাজ একটা তোয়ালে নিয়ে গোসলে ঢুকে যাচ্ছে।

মে মাসের ভয় মে মাসেই পড়ে রইলো। জুন আসতেই পকেটের পেন ড্রাইভ বুকের বা পাশটা কামড়ে ধরল। লে-আউট তৈরি, প্রুফ রিডিং শেষ, ভয় যা পাওয়ার পেয়ে গেছি, এবার ছাপানোটা কেবল বাকি। কিন্তু ছাপাবে টা কে? আমরা তিনজন হন্যে হয়ে ছাপাখানা খুঁজছি কিন্তু কেউ রাজি হচ্ছে না। বুকের কামড়টা একদিন গর্ত হয়ে গেল যখন জুলহাজ হতাশ হয়ে বলল, চলো এটা পিডিএফ করে অনলাইনে দিয়ে দেই। ওর মুখের দিকে তাকালে হয়তো ওর হতাশাটা বুঝতে পারতাম। একটা পিডিএফ ম্যাগাজিন ডিজাইন করতে যে সময় লাগে, তার দশগুণ কাজ করে কাগজে ছাপা হবে বলে রাতদিন খেটেখুটে যে লে-আউট দাঁড়া করিয়েছি, সেটা এভাবে অনলাইনে দিয়ে দেবো? জুলহাজের উপর খুব রাগ হল, গাধার খাটনিটা আমায় খাটতে হয় বলে কি সেটা এভাবে হেলায় ফেলে দিবো! ! ছুটলাম অভিদার কাছে, অভিজিৎ রায়। উনি চোখ বুজে পাঠালেন টুটুল ভাই- এর শুদ্ধস্বরে। তখনো জানি না যে এদের সবাইকে গিলে খেতে কি এক বুনো অজগর অন্ধকারে ওঁত পেতে ছিল।

আজান শেষ। পাশের অন্ধকার গলি থেকে হঠাৎ মাসুম ভাই বেরিয়ে এলো। খাটো করে পেট মোটা লোকটার চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। বেচারার হাতে এখনো ঘুগনি মাখানো মুড়ি লেগে আছে। কাউকে খুঁজে না পেয়ে নিজেই ইফতারি ফেলে আমাদের এগিয়ে নিতে এসেছে। মুখের দিকে তাকালাম, সেখানে ঈদের দুদিন আগেও প্রেস খুলে রাখার বিরক্তি স্পষ্ট। সে বারবার বলছিল যে আমাদের জন্য ঈদে বাড়ি যাবার টিকেট পায়নি, এখন মাইক্রো ভাড়া করে যাওয়া লাগবে। চাপটা আসলে আমরাই দিচ্ছিলাম। খুব চাচ্ছিলাম ঈদ এর দিন রূপবান বের করে সবাই মিলে একটা অন্যরকম ঈদ করবো। গত সাত মাস ধরে আমরা একসাথে যে ম্যাগাজিন ‘কন্সিভ’ করেছি, তাকে চূড়ান্ত আকারে দেখার উত্তেজনায় আমাদের সবার তখন গা গরম হয়ে আছে। মাসুম ভাইয়ের বিরক্তি সেই উত্তাপে কোনো শীতলতা আনতে পারেনি।

জুলহাজ গোসল থেকে বের হতেই পুরো ঘর মানুষ দিয়ে ভরে গেল। নানা রকমের মানুষ, নানা ধরনের মানুষ। কেউ কাছে আসতে চায়, কেউ নাগাল পেতে চায়। এরমধ্যে কে যেন ছুটে এসে উটপাখির পালক বসানো গাউনটা পরিয়ে দিলো, একজন পায়ের কাছে রাজ নাগাড়া নিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষমান। তাকে কোনো সুযোগ না দিয়েই টেবিল থেকে অ্যাপেলের প্যাডটা হাতে নিয়ে বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো জুলহাজ। সেটা কি গাউনের ভার নাকি রাজকীয় কোনো ব্যাপার বুঝতে পারলাম না। একটু পর পর ট্যাবটা থেকে শব্দ আসছে ‘সুইট’ ‘সুইট’! ক্যান্ডি ক্রাশের অসহ্য শব্দে আমার মাথা ধরে যাচ্ছে। ওর চারপাশের ভিড়টা আরও বাড়ছে। সবাই চোখ-মুখ বড় করে মুগ্ধ হয়ে ওর ক্যান্ডি ক্রাশ খেলা দেখছে। কারো কারো মুখ হা হয়ে ভিতরের আল-জিহ্বা দেখা যাচ্ছে, মুখ থেকে লালা গড়িয়ে পড়ছে। কেউ একজন এক কোনায় বসে ময়ূরপুচ্ছের পালক দিয়ে একমনে মুকুট তৈরি করছেl

-‘সুইট’!

জুলহাজের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, ও একমনে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলে যাচ্ছে।

-‘সুইট’!

বিকট হাততালিতে পুরো ঘর গমগম করে উঠলো।

-‘সুইট!’

হাততালি সাথে কারা কারা যেন অতি উৎসাহে শিষ বাজানো শুরু করলো।

-‘সুইট’!

একদল লোক এবার দাঁড়িয়ে গেল স্ট্যান্ডিং ওভেশন দিতে।

-‘সুইট’

-’সুইট’

-’সুইট’

আমি আর নিতে পারছি না। মাথা ব্যথা বাড়ছে এত সার্কাসের মাঝে। একটা লোক বাদশাহি গাউন পরে কোন রুচিতে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলতে পারে তা মাথায় আসছে না। বাইরের মোম তখন শেষের দিকে, মাছগুলো ঐ দিশেহারা আলো-বাতাসের সাথে নিজেদের অনেকটা মানিয়ে নিয়েছে। আমিই কেবল মানাতে পারলাম না। বের হবার জন্য দরজার দিকে তাকাই। সে কি আমার অভিমান-নাকি ব্যর্থতা!

টুটুল ভাই অসম্ভব সাহসী এক অধ্যায়ের নাম। উনি আমাদের ম্যাগাজিন ছাপাতে রাজি হলেন। নীতিগত কারণেই। মজার ব্যাপার হল, এর মধ্যে আরেকজনকে খুঁজে বের করলাম যে টুটুল ভাইয়ের চাইতে কম টাকায় রূপবান ছাপাতে রাজি। একদম নাই ছাপাখানা থেকে দু-দুটো ছাপাখানা, জুলহাজ বেশ পুলকিত। রূপবানের সিএনজি ভাড়া থেকে শুরু করে প্রেসের টাকা পর্যন্ত পুরোটাই আসতো জুলহাজের পকেট থেকে। প্রথম সংখ্যার পর অনেকেই রূপবান প্রকাশের জন্য টাকা দিতে চাইলেও জুলহাজ অন্যের টাকায় রূপবান করতে আগ্রহী ছিল না। ওর একটাই কথা, প্রথম সাতটা সংখ্যার টাকা আমি দিবো। জুলহাজের এই নীতির সাথে আমার দ্বিমত থাকলেও একটা লোকের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা টাকা এভাবে তো চাইলেই আমি ওড়াতে পারি না। টাকার কথা মাথায় রেখেই টুটুল ভাইকে রূপবান না দিয়ে কম কোটেশনের দিকে ঝুঁকলাম। কিন্তু ভয় পিছু ছাড়ল না। যে ছাপাখানা রূপবান ছাপাতে রাজি হল তার মালিক বাংলাদেশের খুবই প্রভাবশালী এক জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক। তারা সস্তায় ছাপাবে কিন্তু একটাই শর্ত, তাদের নাম কোথাও বলা যাবে না। এরপর আমি, জুলহাজ আর আমাদের তিন নাম্বার মাস্কেটিয়ার্সকে নিয়ে সেই বিখ্যাত সম্পাদকের বাসায় গোপন মিটিং করলাম। এর আগে তাকে শুধু টিভিতেই দেখেছি, সামনাসামনি কথা এই প্রথম। উনি কেন এরকম একটা রিস্কি প্রজেক্টে রাজি হলেন সেটা আজও আমার কাছে রহস্য। টাকার জন্য যে উনি রাজি হননি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জুলহাজের মনেও অনেক দ্বিধা কিন্তু ততক্ষণে কথাবার্তা এতটাই এগিয়েছে যে আর পেছানো যাবে না।

মাসুম ভাইয়ের প্রেস সেই নামকরা দৈনিকের ছাপাখানা। উনার অফিসটায় উঠতে গোল করে যে প্যাঁচানো টিনের সিঁড়ি, তারচেয়ে সরু আর লক্করঝক্কর সিঁড়ি আমি আমার জীবনে চড়িনি। উপরে উঠেই দিস্তা দিস্তা কাগজের ছড়াছড়ি আর কাঁচা রঙের গন্ধ। একটা ফ্যানও চলছে না তাই গুমোট গরমে সবাই ঘামতে শুরু করেছি। এরমধ্যে মাসুম ভাই আমাদেরকে চেয়ারে বসিয়ে হাওয়া হয়ে গেলেন। আমরা কেউ কোনো কথা বলছি না, গন্ধে নাকি উত্তেজনায় সবাই সবার দম খিঁচে আছি। টেবিলের উপর মাসুম ভাইয়ের আধ-খাওয়া মুড়ি ভর্তার উপর একটা ঢ্যাঁপসা নীল মাছি ভনভন করছে। মাসুম ভাই আবার অন্ধকার থেকে বের হয়ে এলো, এবার আর হাতে মুড়ি মাখা লেগে নেই। হাত ধুয়ে রূপবানের দুইটা কপি নিয়ে এসেছে। আমার দম একদম বন্ধ হয়ে গেল।

হঠাৎ দরজায় মুহুর্মুহু কিলের শব্দ । সব কোলাহল আর হাততালি মুহূর্তেই থেমে গেল। কেউ কেউ ভয়ে খাটের তলায় আর বাথরুমে পড়ে লুকোলো। জুলহাজ ঘরে থাকা বাকিদের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলল,

-মনে হয় কুরিয়ার সার্ভিস। এত ভয় পাওয়ার কি আছে। আজ দুপুরেও একবার এসেছিল। আমাকে ভয় দেখাচ্ছে শুধু শুধু।

আমি আর জুলহাজ রূপবানের নতুন কপি হাতে নিয়ে বসে আছি। আমাদের সব উত্তেজনা এক মুহূর্তে উবে গেছে। যত পাতা উল্টাচ্ছি তত বিস্ময় অপেক্ষা করছে। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় মুখ খুললাম-

-মাসুম ভাই, রূপবানের লোগো তো এইবার নীল, এখানে তো শেড কালো হয়ে গেছে। আর এই ছবি দেখেন, এইটার উপর চারটা এক্সট্রা লেয়ারের শেড। ভিতরের লেখা দেখছেন, বেশিরভাগ কেঁপে গেছে, অনেক লেখা তো পড়াই যাচ্ছে না! এটা কি সর্বনাশ করছেন আপনি।

আমার সাথে পাক্কা নজরের জুলহাজ এবার তাল মেলালো। রং নিয়ে তর্কাতর্কি শুরু হয়ে গেল। জুলহাজ আর আমি জোর গলায় বলছি যে একটা রঙের শেডও ঠিক নেই। সব ভুলভাল রং। জুলহাজ বলল,

-আপনি আরও কপি আনেন, আমরা দেখবো।

মাসুম ভাই নিম-মুখ করে ভিতরে চলে গেল।

কখনো বুঝবে…এবং উপলব্ধি করবে…কতটা ভুল বুঝেছিলে তুমি…ভালোবাসার মর্যাদা করতে শেখো, সুখি হবে…

জুলহাজ দরজা খুলতেই ধাক্কা দিয়ে ওর মা ভিতরে ঢুকে পড়লো!

-বাসাটারে কি পাইছোস মুমন! এইটা কি একটা ভদ্রলোকের বাসা নাকি বাজার!

-আম্মা, কি হয়েছে? চিৎকার করছ কেন!

-আমি একটা বয়স্ক মহিলা, নামাজটাও ঠিক মত পড়তে পারি না। আমার সামনে দিয়া সারাক্ষণ অচেনা পোলাপাইন যাওয়া আসা করে। তুই বাসাডারে কি পাইছোস?

-অচেনা মানুষ তুমি আগে দেখো নাই আম্মা? তোমার স্বামী যখন মুক্তিযুদ্ধ করেছে, রাজনীতি করেছে, তখন কি বাসায় নতুন মানুষ আসতো না?

-মুমন, তুই আমার বাসায় এত মানুষ আনতে পারবি না।

-আচ্ছা, ঠিক আছে, আমিও তাহলে তোমার বাসায় থাকবো না। আমি নতুন বাসা খুঁজে নেব। এখন তুমি বের হও আমার রুম থেকে।

-কি? আমারে তুই আমার বাসা থেইকা বাইর কইরা দিবি?

-হ্যাঁ দিবো, অনেক নাটক হইছে, বের হও এখন। আমি দরজা লাগাবো।

মাসুম ভাই টেবিলের উপর রাখা বাটি থেকে স্যামটা লাগা মুড়ি খেতে শুরু করেছে। আমি তার সামনে বসা, আমার দিকে না তাকিয়ে তিনি দূরে দরজার কাছে জমাট বাঁধা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। টেবিলের উপর ছড়ানো ছিটানো রূপবানের কপি। ছয়শ কপির পুরো লট প্রিন্ট হয়ে গেছে।

-মাসুম ভাই, আমাকে মাফ করেন। আমি এখান থেকে একটা রূপবানও নিতে পারবো না। আমি দুই মাস ধরে এটার ডিজাইন দেখছি, আমার পক্ষে এই ভুল জিনিস নেয়া সম্ভব না।

জুলহাজ এবার গলা মেলালো,

-আপনি বলেন এটার সমাধান কি। আপনি নিজে বিচার করে বলেন।

মাসুম ভাই একমনে স্যামটা লাগা মুড়ি মুখে পুরে যাচ্ছে। আমাদের দিকে না তাকিয়েই বলতে লাগলো,

-আপনারা চিন্তা কইরেন না। আমি পুরাটা আবার প্রিন্ট করবো। আপনাদের কোনো টাকা দেয়া লাগবে না। পুরাটা আমরা আবার করে দিবো। শুধু কাগজের খরচটা দিয়েন পারলে। আমার বিরাট লস হইবো কিন্তু আমি এটা করে দিবো। পরশু ঈদ, সবাই বাড়ি যাবে। আমারে মাইক্রো ভাড়া করে যেতে হবে। আমি কথা দিতেছি ঈদের এক সপ্তাহ পর আমি এই ম্যাগাজিন ছাপাইয়া দিমু। আপনারা বাসায় যান। এই ছয়শো কপি আমি কাটার দিয়া কাইটা ফালায়ে দিমু।

ঘরের দরজা লাগাতেই আবার শোরগোল শুরু হলো। একটা চেয়ার চলে এসেছে ততক্ষণে, ওকে টেনেটুনে ওখানে বসাতে চাইছে। আমার মাথা ব্যথায় তখন ছিঁড়ে যাচ্ছে। দরজার হাতলে হাত দিতেই আমার আমার চশমাটা ভেঙ্গে দু-টুকরো হয়ে গেলো। এরমধ্যে, ঐ অতো শোরগোলের মধ্যেও জুলহাজের কান্নাটা ঠিক শুনতে পেলাম। গ্রিল কেটে চোর এসে মিরাকে চুরি করে ক্যাফেতে নিয়ে গেছে। নাকি মিরা নিজেই গ্রিল ভেঙ্গে নিচে লাফ দিলো? এবার বিচ্ছেদের সময় হয়েছে বুঝতে পেরেই ঘাড়ের কামড়টা বুকে দাঁত বসালো। হঠাৎ দাঁড়িয়ে দরজা খুলে বের হয়ে গেলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি চোখমুখ মুছে ইমেইল লিখছে জুলহাজ,

-কখনো বুঝবে…এবং উপলব্ধি করবে…কতটা ভুল বুঝেছিলে তুমি…ভালোবাসার মর্যাদা করতে শেখো, সুখি হবে…

এসমস্ত ঘটনার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আবার মাগরিবের আজান পড়ে যায়। অফিস থেকে নাখালপাড়ায় যেতে হয় না বলে সোজা বাসায় চলে আসে জুলহাজ। বাসায় ফিরে বক্সার আর সেন্টো গেঞ্জি গায়ে পরে ঘর পরিষ্কার করে, হয়তো গোসল সারে। এরপর মোম ধরাতে যাবে এমন সময় দরজায় কলিং-বেল। মিরাকে আস্তে করে ঘর থেকে বের করে দরজা খুলতে যায় জুলহাজ। তারপর অনেক শোরগোল আর চীৎকার। শব্দ শুনে ওর মা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, মিরা ভয়ে ওর মায়ের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। জুলহাজের মা আবার চিৎকার করতে থাকে,

-মুমন, তুই বাসায় আবার নতুন লোক আনছোস? বাসাটারে কি পাইছোস? এইটা কি মাছের মাজার?

এরপর মুমনকে আর কোথাও খুঁজে পায়নি মিরারা।