বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় আমরা মানুষ যতটা আধুনিক হচ্ছি ঠিক ততটাই প্রাচীন কিছু ভুল ধারণা আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু জুড়ে ঘিরে আছে। এমন একটি বিষয় হলো সমকামিতা। এ’যুগে এসেও অনেক মানুষ’ই সমকামিতাকে মনে করেন “অসুস্থতা” কিংবা “ভ্রান্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য” যেখানে আধুনিক বিজ্ঞান বলে ভিন্ন কথা। বিশ্বের নামীদামী চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে- সমকামিতা কোন মানসিক রোগ নয়, বরং এটি মানুষের এক প্রকার স্বাভাবিক যৌন প্রবৃত্তি।
সমকামিতা (Homosexuality) হলো এমন এক ধরণের যৌন আকর্ষণ, যেখানে একজন ব্যক্তি নিজেরই সমলিঙ্গের (same sex) প্রতি প্রেম বা যৌন আকর্ষণ অনুভব করে। যেমন, একজন পুরুষ অন্য পুরুষের প্রতি বা একজন নারী অন্য নারীর প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করেন তবে সেটাই সমকামিতা।
এছাড়া আরও কিছু যৌন প্রবণতা রয়েছে, যেমন: যারা নারী-পুরুষ উভয়ের প্রতি আকর্ষিত হয়- বহুকামিতা (bisexuality)। এই বৈচিত্র্যগুলো মানুষে মানুষে তার আচরণগত ভিন্নতা প্রকাশ করে এবং এগুলো সঠিক কিংবা ভুল নয়, বরং প্রকৃতির স্বাভাবিক বৈচিত্র্য।
আধুনিক চিকিৎসকরা এবং মনোবিজ্ঞানীরা সমকামিতাকে স্বাভাবিক যৌনপ্রভৃত্তিই মনে করেন। ১৯৭৩ সালে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন (APA) সমকামিতাকে মানসিক রোগের তালিকা থেকে সরিয়ে নেয় এবং ১৯৮১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) একে মানসিক রোগের তালিকা থেকে অব্যাহতি দেয়। এই সিদ্ধান্ত এসেছে দীর্ঘ গবেষণা ও বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। এছাড়াও গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক বন্য প্রাণীর মধ্যেও সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ দেখা যায়, যেমন – জিরাফ, ভেড়া, বানর, ডলফিন, পেঙ্গুইন ইত্যাদি। এই উদাহরণগুলো আরও প্রমাণ করে যে সমকামিতা কোনো অসামাজিক বা অস্বাভাবিক আচরণ নয়, বরং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের অংশ।
বাংলাদেশে সমকামিতা একটি জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয়। আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরেই এটি সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ ও বিতর্কিত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি হওয়া ভারতীয় দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৩৭৭ ধারায় সমকামিতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও অনেক দেশ এই আইন ইতোমধ্যে বাতিল করেছে, কিন্তু বাংলাদেশে এটি এখনও কার্যকর আছে।
সামাজিকভাবে, সমকামীদের প্রতি রয়েছে প্রচণ্ড কুসংস্কার, ঘৃণা এবং সহিংসতা। এদেশে সমকামী ব্যক্তি সমাজে তাঁদের প্রকৃত পরিচয় গোপন করে চলতে বাধ্য হন। বিশেষ করে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সামাজিক চাপে তাঁরা ভয়, অপমান ও একঘরে হয়ে ওঠার ভয়ে নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন। তবে কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বাংলাদেশে LGBTQ+ সচেতনতামূলক কাজ করছে। যদিও ২০১৬ সালে সমকামী অধিকারকর্মী ও বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সমকামীদের অধিকার বিষয়ক প্রথম পত্রিকা রূপবান এর সম্পাদক জুলহাজ মান্নানকে তার বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করা ছিল এক ভয়ংকর উদাহরণ যে, এই সমাজে এখনো সমকামীদের কতটা ঝুঁকির মধ্যে জীবনযাপন করতে হয়।
এযাবৎকালে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে কিন্তু পথ এখনও অনেকটা দীর্ঘ ও কঠিন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব বিষয়ে এখন আলোচনা শুরু হয়েছে, হয়তো অচিরেই তা পৌঁছে যাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। যদি ঠিকঠাক শিক্ষা, সচেতনতা এবং আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়, তবে সমকামী ব্যক্তিরাও সমাজে তাদের পরিচয় গোপন না রেখে স্বাভাবিক জীবনে বাঁচতে পারবেন।
সমকামিতা নয় কোন পাপ কিংবা অপরাধ এবং নয় কোন মানসিক রোগও। এটি একেবারে মানুষের প্রাকৃতিক যৌন বৈচিত্র্যের অংশ। যেভাবে কেউ ডান হাতে লিখে আর কেউ বাঁ হাতে, তেমনি কেউ বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষিত হয়, কেউ একই লিঙ্গের প্রতি। যা মোটেও অস্বাভাবিক কিছু নয়, এটি শুধু ভিন্ন।