বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন রাষ্ট্র, যার সংবিধান নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার ও মানবাধিকার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করে। কিন্তু সেই রাষ্ট্রেই আজো একটি ঔপনিবেশিক আইন—বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা—সমকামী নাগরিকদেরকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে চলেছে। এ আইনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, যৌন অভিমুখতা ও ভালোবাসার অধিকারকে ফৌজদারি অপরাধে পরিণত করা হয়েছে, যা একবিংশ শতাব্দীর সভ্য সমাজে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।

৩৭৭ ধারা: এক অপ্রাসঙ্গিক আইনের ইতিহাস

 

দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা মূলত ব্রিটিশ শাসনামলে প্রণীত হয়। এ আইন অনুসারে, “প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌন আচরণ” (যার স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই) শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যদিও এ ধারা মূলত পশুর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক ঠেকানোর জন্য তৈরি হয়েছিল, সময়ের ব্যবধানে এটি ব্যবহার করা হয়েছে সমকামীদের দমন ও হেনস্তার জন্য।

আসলে, আইনটিতে “পুরুষ, নারী বা পশু” শব্দগুলোই এ সমস্যার মূল উৎস। সময় এসেছে এই শব্দগুলো বাদ দিয়ে এই ধারা শুধুমাত্র ‘অপ্রাকৃতিক পশুকামিতা’র বিরুদ্ধেই প্রযোজ্য করা—যেমন অনেক আধুনিক দেশ করেছে।

সমকামিতা: অপরাধ নয়, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য

 

একজন মানুষের যৌন অভিমুখতা জন্মগত বা জীবনের প্রাথমিক ধাপে গঠিত হয়। এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক ও জৈবিক বৈশিষ্ট্য, যা ইচ্ছাকৃতভাবে বদলানো সম্ভব নয়। কেউ যেমন জোর করে বিষমকামী হওয়া বেছে নেয় না, তেমনি সমকামী হওয়াটাও কেউ নিজে বেছে নেয় না।

তাহলে প্রশ্ন হলো—কারো ব্যক্তিগত অনুভব, ভালোবাসা ও আত্মপরিচয়কে কি আইন দিয়ে দমন করা ন্যায়সঙ্গত?

ধর্ম ও সংস্কৃতির নামে বৈষম্যের যৌক্তিকতা নেই

 

প্রায়ই সমকামিতার বৈধতা নিয়ে আপত্তির ভিত্তিতে ধর্মীয় সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধের কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের দণ্ডবিধি শরিয়া আইন নয়, বরং একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের অধীন গঠিত রাষ্ট্রীয় আইন। অতএব ধর্মীয় মতবাদ আইনের ভিত্তি হতে পারে না।

একটি রাষ্ট্র তখনই মানবিক হয়, যখন তা সকল নাগরিকের অধিকারের সমান নিশ্চয়তা দেয়—ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ বা যৌন অভিমুখতা নির্বিশেষে।

আইন সংস্কারই একমাত্র পথ

 

৩৭৭ ধারার একটি সুনির্দিষ্ট ভাষাগত পরিবর্তনই বাংলাদেশে সমকামীদের অপরাধীর তকমা থেকে মুক্ত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি “পুরুষ, নারী বা” শব্দগুলো বাদ দেওয়া হয়, তাহলে এই ধারা শুধুমাত্র পশুকামিতার বিরুদ্ধে প্রযোজ্য হবে, এবং সমকামী যৌন সম্পর্ক স্বাভাবিক ও বৈধ হিসেবে গণ্য হবে।

এছাড়া, বর্তমানে সংসদে আলোচিত বৈষম্য বিরোধী আইন-এ “যৌন অভিমুখতা”কে বৈষম্যের ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। না হলে এই আইনের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যাবে, এবং সমকামী নাগরিকেরা রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার বাইরে রয়ে যাবেন।

ভবিষ্যতের পথে এগোনো

সমকামীদের অধিকার মানে সমাজের ভাঙন নয়, বরং তার মানবিক রূপ প্রকাশ। পশ্চিমা দেশগুলোতে নয়, দক্ষিণ এশিয়াতেও ভারত, নেপাল, তাইওয়ান ইতোমধ্যেই এ ব্যাপারে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশ কেন পারবে না?

দেশে বহু তরুণ-তরুণী, যারা LGBTQ+ পরিচয়ে নিজেদের খুঁজে পান, তারা আজও আত্মপরিচয় গোপন রাখতে বাধ্য হন—হয় পরিবারে ভয়ের কারণে, নয়তো আইনের কারণে। এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক।

উপসংহার

আইন যখন মানুষের অধিকারে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন সেই আইনকে পাল্টানোই হয় সভ্য সমাজের দায়িত্ব। ৩৭৭ ধারার সংস্কার মানে শুধুমাত্র একটি আইন বদল নয়—এটি মানবিকতার পথে বাংলাদেশের এক ধাপ অগ্রসর হওয়া।

এই সংস্কার কঠিন হলেও অসম্ভব নয়—শুধু দরকার সচেতনতা, সদিচ্ছা এবং মানবতাবোধ।

একজন মানুষকে তার ভালোবাসা প্রকাশের জন্য অপরাধী বানানো যাবে না। এখনই সময়—আইন বদলে ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দেওয়ার।