সমকামিতা কী জন্মগত, প্রাকৃতিক বা সহজাত? এ বিষয়টি নিয়ে হয়েছে হাজার হাজার গবেষণা। সেসব গবেষণাগুলোর খুবই ক্ষুদ্র অংশ স্বল্পপরিসরে এখানে আলোচনা করা হলো:
১) জিনগতঃ সমকামিতার সাথে জিনের সংযোগ আছে, এমন তথ্য পাওয়া গিয়েছে ১৯৯৩ সালের ডিন হ্যামারের করা গবেষণায়। [1] ২০১৪ সালে করা বৃহৎ পরিসরে জমজদের উপর করা আরো একটি গবেষণায় এই ফলাফল প্রায় সম্পুর্ণভাবে নিশ্চিত হয় [2]। তবে এতদিন ধরে সুনির্দিষ্ট কোন জিনের জন্য এমনটা হয়; তা নিশ্চিত ছিল না। কিন্তু ২০১৭ এর ডিসেম্বরে নেচারে প্রকাশিত ফলাফল থেকে বলা যায়, এ মুহুর্তে এটা আমরা জানি, সমকামিতার জন্য কোন জিনদ্বয় দায়ী। [3] তাই সমকামিতা যে জেনেটিক্যাল এটা বলতে সম্ভবত এখন খুব একটা দ্বিধা নেই।
২) মস্তিষ্কগতঃ সমকামিতা যে সহজাত, তা নিয়ে এ প্রসঙ্গে আরো কিছু গবেষণা প্রায়সই আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। আর তা হলো, সমকামিতা নামক এই যৌন অভিমুখিতার সাথে মস্তিষ্কের সংযোগ। মস্তিষ্কের INAH3 নামক অংশ পুরুষে নারীর তুলনায় বড় হয়। কিন্তু সাইমন লিভ্যে নামক একজন স্নায়ুবিজ্ঞানী দেখেছেন সমকামী পুরুষের INAH3 আর বিষমকামী নারীর INAH3 প্রায় সমান। [4] অর্থাৎ সমকামী পুরুষের INAH3 বিষমকামীর পুরুষের চেয়ে আকারে সংকুচিত। তবে এ সংকোচন কতটা? এটা হচ্ছে মহিলাদের INAH3 এর আকারের ন্যায়। এই গবেষণাটি পুনঃপ্রতিলিপিত করা হয়েছে, যা আগের গবেষণাটিকে নিশ্চিত করে [5] আরো দেখা গিয়েছে বিষমকামীদের সাথে সমকামীদের INAH3 এর ক্রস সেকশনাল এলাকা ও নিউরনের সংখ্যায় কোনো পার্থক্য নেই।[৫]
এই জায়গা থেকে অনেকের ধারণা হয়েছিল, সমকামী পুরুষদের হয়তো, বিষমকামী নারীর ন্যায় হাইপোথ্যালামাস থাকে। কিন্তু আরেকটি গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে, পুরুষ সমকামীদের সুপ্রাকায়াজম্যাটিক নিউক্লিয়াস; বিষমকামী পুরুষ ও নারীর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। [6]
গবেষণায় আরো দেখা গিয়েছে পুরুষ ও নারী সমকামীর বাম এমিগডালা বিস্তৃত এবং পক্ষান্তরে নারী পুরুষ বিষমকামীর ডান এমিগডালা বিস্তৃত। [7] দেখা গিয়েছে, দুইটি সেরেব্রাল হেমিস্ফিয়ারকে সংযোগকারী হোয়াইট ম্যাটার ফাইবার সমৃদ্ধ এন্টিরিওর কমিশার, নারী ও পুরুষ সমকামীতে; বিষমকামী পুরুষের তুলনায় বড় [8]
অনেকে বলতে পারেন, হয়তো জন্মের পরে, সমকামিতার দরুণ এই ব্রেইনের নানা অংশের পরিবর্তন ঘটেছে। হয়েছে সংকোচন-প্রসারণ। কিন্তু ২০১০ সালে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণা থেকে বলা হচ্ছে, এই ধরনের ব্রেইনের বিকাশ মার্তৃগর্ভেই বিকশিত হয়, যা সোশাল ইমপ্যাক্টের কারণে কোনো ধরনের প্রভাবে প্রভাবিত হয় না। [9]
৩) এপিজেনেটিক সংযোগঃ জীববিজ্ঞানের উদীয়মান এই শাখা থেকে দেখা যায়, সমকামিতার সাথে এপিজেনেটিক সংযোগ আছে [10]
৪) বড় ভাইয়ের সাথে সংযোগঃ সমকামিতার সাথে বড় ভাইয়ের একটা গভীর সংযোগ নিয়ে সাম্প্রতিক সময় গুলোতে বেশ আলোচনা ও রিসার্চ হয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে অজস্র গবেষণা হলেও ২০১৭ এর ডিসেম্বরে প্রকাশিত একটি গবেষণা সকল রিসার্চ কে অতিক্রম করে। এখান থেকেই সুনির্দিষ্টভাবে দেখা গিয়েছে, কেন অধিক বড় ভাই থাকলে ছোট ভাইয়ের সমকামী হবার সম্ভাবনা বাড়তেই থাকে [11] (এই বিষয়ে বিস্তারিত বিজ্ঞান যাত্রা থেকেও দেখতে পারেন- ক)
৫) নারীর উর্বরতাঃ গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে সমকামী পুরুষদের নারী আত্মীয়রা অধিক সন্তান জন্ম দেয়। অর্থাৎ সমকামীতার সাথে নারীর উর্বরতার একটা ইতিবাচক সংযোগ আছে। [12] তাহলে কী এই কারণে সমকামিতার মত অ-উপযোগী একটা বিষয় বিবর্তনীয় ছাকুনিতে এভাভাবে টিকে গেলো?- এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় কি?। [জীববিজ্ঞানের অন্যান্য প্রাণিতে উর্বরতার সাথে সমকামিতার এই সংযোগ নিয়ে পড়তে পারেন, ইস্টিশনে খ) ]
৬) হ্যান্ডেডনেস বা কে কোন হাত ব্যবহার করবে: অসংখ্য মেটা এনালাইসিস থেকে দেখা গিয়েছে, যারা বাহাতি এবং ডান হাত ব্যবহার করেন না; তাদের মধ্যে সমকামিতা অধিক হারে দেখা যায় (অনেকগুলো রিসার্চ একসাথে দেখে নিন, এখান থেকে [13])
৭) প্রযুক্তিগতঃ অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি সমকামিতার সাথে টেকনোলজির একটা গভীর সংযোগ সামনে চলে এসেছে। স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা তৈরী করেছে, সেই ইন্টেলিজেন্স একজন মানুষের চেহারা দেখেই সে সমকামী না বিষমকামী তা নির্ধারণ করে ফেলতে পারবে। গবেষকরা এটা বলছেন, এই বিষয়টা সমকামিতা যে জন্মপুর্ব থেকে নির্ধারিত; এই তথ্যটিকে নিশ্চিত করে। কারণ হলো; একজন মানুষের চেহারা কেমন হবে, তা তার জিন, তার জন্মপুর্ব হরমোন গুলোই নির্ধারণ করে, তাই প্রযুক্তি যেহেতু মানুষের চেহারা দেখেই ধরতে পারছে, সে সমকামি না বিষমকামী; অতএব, এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, যৌন অভিমুখিতা নির্ধারণে প্রকৃতিই ভুমিকা রাখে।[14]
৮)পার্থক্য: সমকামী ও বিষমকামী মানুষদের মধ্যে আরো অনেক পার্থক্য দেখা গিয়েছে। এরকম কিছু পার্থক্য গুলো তুলে ধরি
- A) গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সমকামী পুরুষদের শিশ্ন, বিষমকামীদের তুলনায় দীর্ঘ ও পাতলা হয়[15]
- B) সমকামী পুরুষদের বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি এবং কণিষ্ঠাঙ্গুলির ফিঙ্গারপ্রিন্ট ঘনতর হয়।[16]
- C) শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে করা গবেষণায় দেখা গিয়েছে সমকামী পুরুষদের বাহু এবং হাতের দৈর্ঘ্য সাধারণ জনসংখ্যার তুলনায় ছোট হয়। [16]
- D) সমকামী নারী এবং উভকামী নারীতে স্টার্টল রেসপন্স পুরুষের ন্যায় প্রতিক্রিয়া দেয়। [17] (এই স্টার্টল রেসপন্স বলতে এখানে বুঝানো হয়েছে, উচ্চ আওয়াজ শুনলে আমরা চোখের পাতা যেভাবে নাড়াই বা হঠাৎ আমরা যে প্রতিক্রিয়া দেই সেসব)
এটা আমি বা প্রখ্যাত বিজ্ঞানীদের কেওই বলছে না, সমকামিতা সম্পুর্ণভাবে এই সব কারণের জন্যই হয়, সমকামিতার সাথে আরো অনেক ফ্যাক্টর জড়িত থাকতে পারে। কেও যদি ইচ্ছা করে সমকামিতাকে ফ্যাশন হিসাবে ন্যায়, সেটা তার দায়ভার। কিন্তু এইসব গবেষণার ফলাফল থেকে যে বিষয়টা শতভাগ নিশ্চিত কৃত হয়ে বলা যায়; তা হলো সমকামিতা ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক হবার চান্স অনেক বেশি উচ্চতর। সমকামিতার সাথে মনস্তাত্বিক সমস্যা, রাজনৈতিক বিষয়গুলো, মানবাধিকার, ধর্মীয় নানা কারণ, যৌন রোগ সহ নানা বিষয় জড়িয়ে আছে, যদি কখনো পারি, তবে তা নিয়ে লিখব, আপাতত জীববিজ্ঞানের অংশটাই থাকুক।
তথ্যসুত্রঃ
1) http://science.sciencemag.org/content/261/5119/321.long
2) https://www.newscientist.com/article/dn26572-largest-study-of-gay-brothers-homes-in-on-gay-genes/
3) https://www.nature.com/articles/s41598-017-15736-4
4) http://science.sciencemag.org/content/253/5023/1034
5) https://linkinghub.elsevier.com/retrieve/pii/S0018506X01916800
6) https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/000689939090350K?via%3Dihub
7) https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/18559854
8) https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/7571001
9) https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/19955753
10) https://link.springer.com/article/10.1007%2Fs00439-005-0119-4
11) http://www.pnas.org/content/115/2/302
12) https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/15539346
13) https://bn.m.wikipedia.org/wiki/Handedness_and_sexual_orientation
14) https://osf.io/zn79k/
15) https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/10410197
16) http://nymag.com/news/features/33520/
17) https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/14570558
সহায়ক তথ্যঃ ক) https://bigganjatra.org/fraternal-birth-order-effect/
খ) https://www.istishon.com/?q=node/26150