বাংলাদেশ একটা সেকুলার দেশ। ধর্মনিরপেক্ষতার আদলে গড়া হলেও প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ বলা যায় না। দেশ ধর্মনিরপেক্ষ হলে দেশটির রাষ্ট্র ধর্ম কিন্তু ইসলাম। এই ইসলাম ধর্মকে অস্র  করে চলে  অনাচার। শুধু মাত্র ইসলাম ধর্ম ছাড়া এই দেশের অন্য ধর্মের মানুষরা প্রচণ্ড চাপের মধ্যে থাকে এবং অবহেলিত নির্যাতিত। আমরা এদের কথা বলি না। কারণ যতক্ষণ না পর্যন্ত নিজের উপর কোন সমস্যা না হচ্ছে আমরা এই অনাচার নিয়ে কথা বলি না। শুধু অন্য ধর্মের লোকেরা নয় নির্যাতিত হয় আমার মতো সমকামী অসহায় মানুষগুলো। এদের গল্প গুলো গল্পই থেকে যায়।    

আমাদের সকলের মনে রাখতে হবে একটা স্বাধীন সভ্য দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা প্রত্যেক রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমাদের দেশে অবশ্যই সমকামী বিবাহের আইন করা প্রয়োজন, সমকামীদের সামাজিক ভাবে স্বীকৃতি দেয়া প্রয়োজন। এটা যেকোন সভ্য সমাজের দায়িত্ব।

সমকামীরা সামাজিক অবদমনের কারনে বিভিন্ন প্রকার অপরাধপ্রবনতা এবং একই সাথে আত্মহত্যাপ্রবনতা এবং বিভিন্ন মনোবৈকল্যের শিকার হতে পারেন। এর ভেতরে থাকতে পারে ড্রাগসে আসক্তি, অবদমনের কারনে যৌনতা বিকৃতির দিকে মোড় নেয়া ইত্যাদি। এর পেছনে সমকামিতাকে দায়ী করা যাবে না, সামাজিক অবদমন এবং ধর্মীয় দৃষ্টিতে পাপবোধের সৃষ্টিই এর কারন।

আমাদের দেশে প্রায়শই দেখা যায় ছোট ছোট শিশুরা তাদের বয়ষ্ক আত্মীয়, এলাকার কোন বয়ষ্ক পুরুষ দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হন, যেটার জন্য সমকামীদের ঢালাওভাবে অভিযুক্ত করা হয়। আমরা সমকামীদের সামাজিক ভাবে চিনি নি, আমরা জানি না যে আমাদের পাশের বাসার ভদ্রলোক, যাকে দেখলে খুব আপনি ভাবতেই পারবেন না তিনি সমকামী, যিনি স্ত্রী সন্তান নিয়ে আপাতদৃষ্টিতে সুখে জীবন কাটাচ্ছেন, তিনি হয়তো জন্মগত ভাবেই সমকামী। সামাজিক শৃংখলা আর অবদমনের কারনে তার সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন বিকৃতির দিকে মোড় নিতে পারে, সে ধর্ষকামী/ শিশুকামী তে পরিনত হতে পারে। আধুনিক গবেষনা মতে ধর্ষকামীতা বা শিশুকামীতার সাথে সমকামিতার কোন সম্পর্ক নাই, এবং সমকামিতা কোন মতেই বিকৃতি নয়। তবে সামাজিক ভাবে যৌন অবদমন অবশ্য ধর্ষকামীতা বা শিশুকামীতার মত বিকৃতির জন্ম দিতে পারে বলে মনে করি( এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ আছে, সামাজিকভাবে যৌন অবদমন যে ধর্ষকামীতা/শিশুকামীতার মত বিকৃতির জন্ম দিতে পারে এটা একান্তই ব্যাক্তিগত ধারনা, বৈজ্ঞানিক গবেষনাপ্রাপ্ত ফলাফল নয়)।

তিনি যদি সুস্থ সমকামী জীবন যাপন করতেন, তার যদি একজন পুরুষ সঙ্গী থাকতো, তার এই ধরনের ধর্ষক মনোভাব থাকতো না।সুস্থযৌন আচরন ধর্ষকামীতা/শিশুকামীতা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের বিকৃতি থেকে তাদের রক্ষা করতে পারে যাতে করে আমাদের সমাজের হাজারো শিশু এই ধরনের যৌন নির্যাতন থেকে রক্ষা পায়।

সমকামী পুরুষটিকেও কিন্তু দোষ দেয়া যাচ্ছে না। আমাদের সমাজ তার স্বাভাবিক যৌনতার প্রধান বাধা। সে হয়তো শুরু থেকেই সমকামী, কিন্তু সমাজের চাপে প্রকাশ করতে না পারায় লুকিয়ে লুকিয়েই তার যৌনাকাংখা চরিতার্থ করতে হয়েছে। এই কারনে তার বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সাথে জড়িয়ে পরতে হয়েছে, নিজের অবদমিত যৌনতা উপভোগের জন্য।

কাল এমন হতে পারে যে আপনার ভাই বা বোন সমকামী হয়ে জন্মালো ( সমকামিতার বীজ তার ভেতরে জন্ম থেকেই থাকতে পারে)। তার সমস্যাটাকে আপনি যদি গভীরভাবে বিশ্লেষন বা তদন্ত না করে শুরুতেই আপনার প্রাচীন ধ্যান ধারনা দ্বারা তাকে মারধোর করা শুরু করেন, তাকে চাপ দিতে থাকেন, বেচারা বা বেচারী কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? সে আপনার কাছ থেকে একটু মানবিক আশ্রয় চাইতে পারে, ব্যাপারটা আপনি বুঝবেন সেটা আশা করতে পারে। তার কি দোষ বলতে পারেন? সে বেচারীর যৌন আকাংখা প্রকৃতি ভিন্নভাবে তৈরি করে দিয়েছে। হয়ত সে সারাজীবন মনের একান্ত ইচ্ছাকে গলাটিপে মেরে আপনাদের পছন্দমত বিপরীত লিঙ্গে বিয়ে করে জীবন পার করলো, কিন্তু তারও তো প্রেমের অনুভুতি আছে, তারও তো ভালবাসার মানুষ বেছে নেয়ার অধিকার আছে, কতদিন সে যাকে ভালবাসে না বা যার জন্য তার শরীর সে বিন্দুমাত্র আন্দোলিত, উত্তেজিত হয় না, তার সাথে কষ্টকর যৌনতায় জীবন পার করবে?

আজকে পুরো পৃথিবীর মানবতাবাদীরা সমকামিদের অধিকার রক্ষায় আন্দোলন করে যাচ্ছে। আমরা বাঙ্গালীরা সবই বুঝি, তবে অনেক দেরি করে। আমাদের দেশেও সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, কিন্তু ততদিনে কত সমকামি আমাদের সমাজের হাতে ধুঁকে ধুঁকে মরবে কে তার খোঁজ রাখবে? তাদের কথা না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু লুকিয়া থাকা সমকামীদের হাতে আমাদের কত শিশু যে ধর্ষিত হবে, মানসিকভাবে বিপর্যস্থ হবে, তার খবর কি আমরা রাখি?

আমরা যদি একজন সমকামীকে সামাজিক ভাবে চিহ্নিত করি, তার জন্য পছন্দ অনুসারে বিয়ের ব্যাবস্থা করি, তাতে সমাজের কি ক্ষতি হয়ে যাবে?

আমরা ধর্মীয় গোঁড়া সংস্কৃতির ভেতরে নিজেদেরকে এতটাই জর্জরিত করে রেখেছি যে আমরা মনে করি, আমাদের এই লোক বানানো নিয়ম  গুলো যা আসলেই ইসলাম ধর্মে আছে কিনা সেগুলো বিচার বিবেচনা না করেই আমরা আমরা অন্ধের মতো মেনে যাই। আমরা যারা শিক্ষিত যারা বিজ্ঞান নিয়েও পড়াশোনা করি এমনকি তারা এসকল অবাঞ্ছিত নিয়ম গুলোর পৃষ্ঠ পোষক। আমরা মনে করি আমরা আমাদের সমাজের গোঁড়া নিয়ম গুলো মানলেই সমাজে জায়গা করে নেবো। এই দেশে থাকার অধিকার রাখবো। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে আমরা আসলেই কি এই সমাজে থাকার জায়গা করে নিয়েছি!